ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মেজর জিয়ার অবস্থান নিয়ে ক্রমেই রহস্যের জট বাড়ছে;###;অজানা কারণে থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে

কারও শাস্তি হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:০১, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬

কারও শাস্তি হয়নি

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশে গত তিন বছরে অন্তত বারো প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তবুদ্ধির মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচারে শাস্তি হয়নি। জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিম সংঘটিত করেছে এসব হত্যাকাণ্ড। এসবে নেতৃত্ব দিয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সামরিক কমান্ডার সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া। গত তিন বছরে মেজর জিয়াকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হলেও তার নেতৃত্বে প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবীর হত্যাকা-ের ঘটনা বন্ধ করতে পেরেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। মেজর জিয়ার অবস্থান নিয়ে ক্রমেই রহস্যের জট পাকাচ্ছে। রবিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জিয়াসহ(মেজর জিয়া) যেসব জঙ্গী আত্মসমর্পণ করেনি তাদের ধরতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। শীঘ্র সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজিব হায়দার শোভন হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তবুদ্ধির মানুষজনকে হত্যা শুরু করা হয়। তারপর অভিজিৎ রায়, জাফর মুন্সি, তারিকুল ইসলাম শান্ত, মামুন হোসেন জগৎ জ্যোতি তালুকদার, অনন্ত বিজয় দাশ, আরিফ হোসেন দীপ, জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবু, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ফয়সল আরেফিন দীপন, জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহাবুব তনয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আহমেদ রাজিব হায়দারকে হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে দেশে ব্লগার, লেখক, মুক্তবুদ্ধির মানুষজনকে হত্যা করা শুরু হয়। কেবল শোভন হত্যাকা-ের মামলার তদন্ত শেষে চার্জশীট দেয়ার পর আদালতে বিচার চলছে। ওই বছরে অন্তত তিনজনকে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে জঙ্গীরা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু জঙ্গীদের কোন্ গ্রুপ এই ধরনের হত্যাকা- ঘটাচ্ছে তা অজানা থেকে যায় বহুদিন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে কলাবাগানে ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান তার বন্ধু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহবুব তনয়কে হত্যাকা-ের পর থেকে এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশের তরুণ সমাজের সোচ্চার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে ধর্মীয় রঙ দেয় জামায়াত-শিবির। ওই সময় দেশের সকল ব্লগারকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে আন্দোলন শুরু করে হেফাজতে ইসলাম। পরবর্তীতে উগ্র ইসলামী ভাবধারায় পরিচালিত আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের এক নেতার কাছে একটি তালিকা পাওয়া যায়। পাশাপাশি সময়ে আনজুমানে আল বাইয়্যিনাত নামে একটি সংগঠন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্লগারদের একটি তালিকা জমা দেয়। সেই তালিকা ধরে একের পর এক ব্লগার হত্যা শুরু হলে জঙ্গীরা ধরা পড়তে থাকে। ধরা পড়া জঙ্গীরা হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করার পর জঙ্গী বিরোধী অভিযান শুরু হয়। জঙ্গীবিরোধী অভিযানের মধ্যেই নব্য জেএমবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। নব্য জেএমবির গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা ও বড় ধরনের প্রায় একডজন জঙ্গীবিরোধী অভিযানকালে বেশ কিছু নব্য জেএমবির জঙ্গী নিহত, আহত এবং গ্রেফতার হয়। নব্য জেএমবির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের জঙ্গীরা আড়ালে চলে যায়। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান জসিমউদ্দিন রাহমানি গ্রেফতার হলেও সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী অপারেশন কমান্ডার মেজর জিয়া ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়ার নাম ফাঁস হওয়ার পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মেজর জিয়া গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানি গ্রেফতার হওয়ার পরই সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হকের নাম উঠে আসে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারীর অন্যতম হচ্ছেন এই মেজর জিয়া। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) নেতা হলেও জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া। সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টার অভিযোগে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর প্রায় পাঁচ বছর পলাতক থেকে দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিস্তারে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করে আসছে এই শীর্ষ জঙ্গী নেতা। রাজধানী ও এর আশপাশে টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত কয়েক জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে নেপথ্যে মেজর জিয়ার জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পায় গোয়েন্দারা। বিগত পাঁচ বছরে তার (মেজর জিয়া) তত্ত্বাবধানে এবিটির স্লিপার সেল তৈরি হয়েছে। স্লিপার সেলের এসব সদস্যই গত কয়েক বছরে ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা লেখক ও ভিন্নমতাবলম্বীকে হত্যা করেছে। তার সঙ্গে বিদেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থারও তার যোগাযোগ থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। সরকারের পক্ষ থেকে মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। রবিবার রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ‘শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, জিয়াসহ(মেজর জিয়া) যেসব জঙ্গী আত্মসমর্পণ করেননি তাদের ধরতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। শীঘ্র সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
×