ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

সাফল্য ও সম্ভাবনার আগর শিল্প

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

সাফল্য ও সম্ভাবনার আগর শিল্প

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সুগন্ধি ব্যবহার করে আসছে। দেশে-বিদেশে এখন এ সুগন্ধি দ্রব্যের চাহিদা খুব বেশি। আর এর মূল্যও অনেক বেশি। বলতে গেলে অতি উন্নত মানের সুগন্ধি সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সারা পৃথিবীতে এশিয়ার সুগন্ধির বেশ কদর রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানে প্রচুর পরিমাণে ফুলের সুগন্ধি তৈরি হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এ দুটি দেশের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশে উৎপাদিত সুগন্ধি মানে আতর এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সর্বস্তরের মানুষের কাছে অতি আকর্ষণীয়। মৌলভী বাজারের বিশ্বখ্যাত আগর, আতর অতি প্রাচীন সুগন্ধি শিল্প। বহুকাল আগ থেকে মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি হাওড় তীরবর্তী সুজানগর এলাকা এই শিল্পের উৎপাদন, রফতানিকরণ ও ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ লাভ করে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত সুজানগর অঞ্চলে হাজার হাজার আগর, আতর ব্যবসায়ী ও শ্রমিক যেমন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। এক কেজি আগর তেলের বাজার মূল্য ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা, কখনও ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা একটি আগর গাছের মূল্য হবে ভাবতেও অবাক লাগে। একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছের মূল্য ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। তেল তৈরির পর এ গাছের কাঠের টুকরোগুলো সুগন্ধি জ্বালানি হিসেবে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৩ বছরের পূর্ণ বয়স্ক একটি আগর গাছ থেকে প্রক্রিয়া শেষ ২৫-২৬ গ্রাম তেল পাওয়া যায়। আগর গাছের চারা রোপণ করে পরিকল্পিত বাগান করে এক হাজার আগর গাছ থেকে মাত্র ১৩-১৪ বছর পর প্রায় দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত উপার্জন করা সম্ভব। অথচ এ পরিমাণ চারা তৈরি ও বাগান করতে ব্যয় হবে মাত্র ২৫-৩০ হাজার টাকা। বড়লেখা থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে সুজানগরে ঢুকলেই পিচঢালা সড়কের দুই পাশে রয়েছে অসংখ্য আগরগাছ। অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারগুলো এক-দুই বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছে আগরবাগান। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেন, সরকার এ শিল্পে মনোযোগী হলে আগর-আতর বাংলাদেশের একটি প্রিমিয়াম পণ্য হতে পারে। পোশাক শিল্পের পরেই হতে পারে এর স্থান। বিশ্ববাজারে এর চাহিদা আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বন বিভাগ থেকে সাইটিস ছাড়পত্র পাওয়া নিয়ে জটিলতা, গ্যাসের অপ্রতুলতা, শিল্পঋণের অভাব, পণ্যের মান যাচাই করার যন্ত্রপাতির অভাবের সম্ভাবনাকে বাড়তে দিচ্ছে না। আতরের মান নির্ণয়ে দেশে কোন ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক দাম পান না তাঁরা। উদ্যোক্তারা বলেন, আতরশিল্প বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। বিশেষ করে আগর থেকে যে প্রক্রিয়ায় নির্যাস নেয়া হয় তা মান্ধাতার আমলের। এ শিল্পের বিকাশে স্বল্পসুদে ব্যাংকঋণ পাওয়া দরকার; কিন্তু পাওয়া যায় না। আমদানিকারক দেশগুলো উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করায় সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের ১২১টি আগর কারখানার সব ক’টিই সিলেট বিভাগে অবস্থিত। এর মধ্যে মৌলভী বাজারের বড়লেখায় ১১১, কুলাউড়ায় ৬, কমলগঞ্জে ২ ও সিলেট সদরে ২ কারখানা রয়েছে। কাঁচামাল সঙ্কট ও কারখানাগুলোতে গ্যাস সংযোগ না থাকায় ৫০-এর দশক থেকে সিলেটের অনেক কারখানা ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে। এ অবস্থায় সম্ভাবনাময় এ রফতানি খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে ১৯৯৮ সালে বন বিভাগ বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয়। এর আওতায় সিলেট বিভাগে ৭৮৫ দশমিক ৬৭ হেক্টর জমিতে আগরবাগান সৃজন ও স্থানীয় চাষীদের আগর বনায়নে উৎসাহিত করা হয়। সরকার আগরকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করায় সশ্লিষ্টরা এ খাতকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। আগর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সিলেটের বনাঞ্চল থেকে সংগৃহীত আগর প্রক্রিয়াজাত করে চিপস (গাছের ভেতরের অংশ) ও তেল (আতর) আকারে বিদেশে রফতানি হয়। সিলেটের আগরের সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এছাড়া ভারত, সিঙ্গাপুর ও জাপানেও আগর রফতানি হয়। বাংলাদেশ থেকে বছরে কোটি কোটি টাকার আতর রফতানি হয়। চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ এ শিল্পে কাজ করে। একজন শ্রমিক দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরি পায়। তাছারা আতর এমন একটি শিল্প, যেখানে কোন উচ্ছিষ্ট তৈরি হয় না। ১৯৯৪-৯৫ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরীক্ষামূলক আগর চাষের উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ। এ সময় ২ হাজার ৫শ আগরের চারা রোপণ করা হয় শ্রীমঙ্গলের মাগুরছড়া ও জুড়ির লাঠিটিলা পাহাড়ে। ১৯৯৬ সালে সরকার এ দিকে দৃষ্টি দেয়ার পরে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার আগর গাছের চারা লাগিয়ে বনায়নের কাজ শুরু করে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ হবে স্বাবলম্বী। সরকারী পর্যায়ে পাথারিয়া এলাকায় পরিত্যক্ত খাস জমিতে আগর গাছের চাষ করে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ আগর কাঠ সংগ্রহ করা যাবে পাশাপাশি আয় করা সম্ভব হবে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।
×