ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রিয়াজুল হক

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন

সহজ কথায়, কালো টাকা বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে লেনদেনের উপযোগী করে স্বচ্ছতা প্রদান করার প্রক্রিয়াকে মানিলন্ডারিং বলে। দেশের অর্থনীতির জন্য মানিলন্ডারিং হুমকিস্বরূপ। সরকার বঞ্চিত হয় কাক্সিক্ষত রাজস্ব থেকে এবং দেশে উন্নয়নের গতি বাধাগ্রস্ত হয়। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধন, ২০১৫) এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘মানিলন্ডারিং’ অর্থ (অ) নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্যে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত সম্পত্তি জ্ঞাতসারে স্থানান্তর বা রূপান্তর বা হন্তান্তর: (১) অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন বা ছদ্মাবৃত্ত করা; অথবা (২) সম্পৃক্ত অপরাধ (দুর্নীতি ও ঘুষ; মুদ্রা জালকরণ; দলিল দস্তাবেজ জালকরণ; চাঁদাবাজি; প্রতারণা; জালিয়াতি; অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা; অবৈধ মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা; চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা; অপহরণ, অবৈধভাবে আটকিয়ে রাখা ও পণবন্দী করা; খুন, মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি; নারী ও শিশু পাচার; চোরাকারবার; দেশী ও বিদেশী মুদ্রা পাচার; চুরি বা ডাকাতি বা দস্যুতা বা জলদস্যুতা বা বিমান দস্যুতা; যৌতুক; চোরাচালানী ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধ; কর সংক্রান্ত অপরাধ; মেধাস্বত্ব লংঘন; সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থ যোগান; ভেজাল বা স্বত্ব লঙ্ঘন করে পণ্য উৎপাদন; পরিবেশগত অপরাধ; সংঘবদ্ধ অপরাধ বা সংঘবদ্ধ অপরাধী দলে অংশগ্রহণ; ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায়; এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্তৃক সরকারের অনুমোদনক্রমে গেজেটে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষিত অন্য যে কোন সম্পৃক্ত অপরাধ) সংগঠনে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ হইতে রক্ষার উদ্দেশ্যে সহায়তা করা; (আ) বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার করা; (ই) জ্ঞাতসারে অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করিবার উদ্দেশ্যে উহার হস্তান্তর, বিদেশে প্রেরণ বা বিদেশ হইতে বাংলাদেশে প্রেরণ বা আনয়ন করা; (ঈ) কোন আর্থিক লেনদেন এইরূপভাবে সম্পন্ন করা বা সম্পন্ন করিবার চেষ্টা করা যাহাতে এই আইনের অধীন উহা রিপোর্ট করিবার প্রয়োজন হইবে না; (উ) সম্পৃক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররোচিত করা বা সহায়তা করিবার অভিপ্রায়ে কোন বৈধ বা অবৈধ সম্পত্তির রূপান্তর বা স্থানান্তর বা হস্তান্তর করা; (ঊ) সম্পৃক্ত অপরাধ হইতে অর্জিত জানা সত্ত্বেও এই ধরনের সম্পত্তি গ্রহণ, দখলে নেওয়া বা ভোগ করা; (ঋ) এইরূপ কোন কার্য করা যাহার দ্বারা অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করা হয়; (এ) উপরে বর্ণিত যে কোন অপরাধ সংঘটনে অংশগ্রহণ, সম্পৃক্ত থাকা, অপরাধ সংঘটনে ষড়যন্ত্র করা, সংঘটনের প্রচেষ্টা অথবা সহায়তা করা, প্ররোচিত করা বা পরামর্শ প্রদান করা। বাংলাদেশে মানি লন্ডারিংয়ের প্রকৃত অবস্থা সুখকর নয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) দেয়া তথ্য মতে, ২০০৪ থেকে ২০১৩ এক দশকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। বর্তমানে গড়ে প্রতিবছর ৫৮৯ কোটি মার্কিন ডলার অর্থ পাচার হচ্ছে। ছোট এই দেশের জন্য ভয়াবহ এক চিত্র। দেশের উন্নয়নের গতিধারাকে ধরে রাখতে হলে মানি লন্ডারিংয়ের লাগাম টেনে ধরতে হবে। কারণ মানি লন্ডারিংয়ের কারণে দেশ বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির মধ্যে পরে যায়। বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মানিলন্ডারিং অপরাধ ও দ- সম্পর্কে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে বলা হয়েছে- (১) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, মানিলন্ডারিং একটি অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। (২) কোন ব্যক্তি মানিলন্ডারিং অপরাধ করিলে বা মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করিলে তিনি অন্যূন ৪ (চার) বছর এবং অনধিক ১২ (বার) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ (দশ) লাখ টাকা পর্যন্ত, যাহা অধিক, অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন [তবে শর্ত থাকে যে, আদালত কর্তৃক ধার্যকৃত সময়সীমার মধ্যে অর্থদণ্ড পরিশোধে ব্যর্থ হইলে আদালত অপরিশোধিত অর্থদণ্ডের পরিমাণ বিবেচনায় অতিরিক্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে।] (৩) আদালত কোন অর্থদণ্ড বা দণ্ডের অতিরিক্ত হিসেবে দণ্ডিত ব্যক্তির সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াফত করিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে যাহা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানিলন্ডারিং বা কোন সম্পৃক্ত অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা সংশ্লিষ্ট। (৪) কোন সত্তা এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটন করিলে বা অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করিলে ধারা ২৭ এর বিধান সাপেক্ষে, উপ-ধারা (২) এর বিধান অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে এবং অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মূল্যের অন্যূন দ্বিগুণ অথবা ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা, যাহা অধিক হয়, অর্থদ- প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিলযোগ্য হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত সত্তা আদালত কর্তৃক ধার্যকৃত সময়সীমার মধ্যে অর্থদ- পরিশোধে ব্যর্থ হইলে আদালত অপরিশোধিত অর্থদ-ের পরিমাণ বিবেচনায় সত্তার মালিক, চেয়ারম্যান বা পরিচালক যে নামেই অভিহিত করা হউক না কেন, তাহার বিরুদ্ধে কারাদ-ে দ-িত করিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে।] (৫) সম্পৃক্ত অপরাধে অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হওয়া মানিলন্ডারিং এর কারণে অভিযুক্ত বা দণ্ড প্রদানের পূর্বশর্ত হইবে না। মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত কেউ যেন আইনের ফাঁক ফোকর গলে বের হয়ে যেতে না পারে, সেই বিষয়ে অবশ্যই কঠোরতা প্রয়োজন। বড় কয়েকটি শাস্তির দৃষ্টান্ত তৈরি হলে, অন্যরা অবশ্যই দেশের স্বার্থবিরোধী এই কর্মকা- থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেবে। উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য অবশ্যই মানিলন্ডারিং নামক অবৈধ অর্থ প্রবাহের অবৈধ কারবার বন্ধ করতে হবে। এজন্য আইনের শাসনের কোন বিকল্প নেই।
×