ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এফবিসিসিআই নির্বাচন পদ্ধতিতে সংস্কার আনা হচ্ছে

সব পদে সরাসরি ভোট, পরিচালনা পর্ষদে সদস্য বাড়ছে ৮ জন

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

সব পদে সরাসরি ভোট, পরিচালনা পর্ষদে সদস্য বাড়ছে ৮ জন

এম শাহজাহান ॥ সকল পদে সরাসরি ভোটের বিধান রেখে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নির্বাচন পদ্ধতিতে সংস্কার আনা হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদে সদস্য সংখ্যা ৮ জন বাড়িয়ে প্রথমবারের মতো একজন প্রথম সহসভাপতি (ফাইন্যান্স এ্যান্ড ট্যাক্স পলিসি) পদ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিচ্ছে সংস্কার কমিটি। বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বিতর্কিত ‘মনোনীত পরিচালক’ প্রথা একেবারে বাতিল না করে তাদের নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদে নিয়ে আসার বিধান করা হচ্ছে। আগামীতে এ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ৩০ জন পরিচালক ১৫-১৮টি খাতভিত্তিক ক্লাস্টার হতে নির্বাচিত হবেন। একই সঙ্গে চেম্বার গ্রুপের ৩০ জন পরিচালক অঞ্চলভিত্তিক নির্বাচিত হবেন। এফবিসিসিআই নির্বাচন রিফর্মস কমিটি এভাবেই তাদের ফর্মুলা চূড়ান্ত করে এনেছে। আগামী ১৫ ডিসেম্বর সংস্কার প্রস্তাবটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ও সহসভাপতি এবং পরিচালকের পদগুলোতে সরাসরি ভোট চেয়ে আসছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের এ দাবি পূরণে আন্তরিক আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। তাই বাণিজ্য সংগঠনসমূহের অভিভাবক খোদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেই এবার নির্বাচন পদ্ধতির আমূল সংস্কারের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারে সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারী খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে, যার সদস্য হিসেবে রয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতিরা। এ কমিটি নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারে একটি ফর্মুলা চূড়ান্ত করে এনেছে। তবে বিতর্কিত মনোনীত পরিচালক প্রথা একেবারে বাতিল না করে বরং নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের পরিচালনা পর্ষদে নিয়ে আসার ব্যাপারে কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। ভোটার তালিকা সংশোধন করে নামসর্বস্ব বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোকে বাদ দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আবদুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে এফবিসিসিআই নির্বাচন পদ্ধতিতে সংস্কার আনা হচ্ছে। সকল পদে যাতে সরাসরি ভোট হতে পারে সেই পদ্ধতিতে যাওয়া হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন পদ্ধতিতে কী ধরনের সংস্কার হবে সেলক্ষ্যে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। ওই কমিটির প্রস্তাব ও সুপারিশগুলো পাওয়ার পর এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আশা করছি, শীঘ্রই কমিটির প্রস্তাবগুলো পাওয়া যাবে। নির্বাচন পদ্ধতিতে যেসব সংস্কার করা হচ্ছে ॥ ৩০ জন পরিচালক এ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ হতে এবং ৩০ জন পরিচালক চেম্বার গ্রুপ থেকে স্ব-স্ব গ্রুপের সাধারণ পরিষদ সদস্যদের দ্বারা সরাসরি গোপন ব্যালটে নির্বাচিত হবেন। সাধারণ পরিষদে অন্তর্ভুক্ত ভোটারগণ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। নির্বাচনে প্রার্থী হতে নিজস্ব সমিতি বা চেম্বার হতে কোন অনুমতি ও সিদ্ধান্ত লাগবে না। এ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ৩০ জন পরিচালক ১৫-১৮টি খাতভিত্তিক ক্লাস্টার হতে নির্বাচিত হবেন। অপরদিকে চেম্বার গ্রুপের ৩০ জন পরিচালক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় অঞ্চলভিত্তিক নির্বাচিত হবেন। সভাপতি, প্রথম সহসভাপতি ও সহসভাপতি (২ জন) এই চার গুরুত্বপূর্ণ পদে গোপন ব্যালটে ভোটগ্রহণ করা হবে। তবে ভোট দিতে পারবেন না সাধারণ পরিষদ সদস্যরা। ভোট দেবেন অঞ্চলভিত্তিক চেম্বার এবং খাতভিত্তিক এ্যাসোসিয়েশন থেকে নির্বাচিত পরিচালক আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত এ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বার সভাপতিরা। কমিটির প্রস্তাবিত ফর্মুলা অনুযায়ী, এ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বার গ্রুপ থেকে ৩০ জন করে মোট ৬০ জন হবেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক। মেয়াদ হবে ২ বছর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত এ্যাসোসিয়েশনগুলোকে খাতভিত্তিতে ১৫-১৮টি এবং চেম্বারগুলোকে অঞ্চলভিত্তিতে ১১টি ভাগে ভাগ করা হবে। এই খাতভিত্তিক এ্যাসোসিয়েশন এবং অঞ্চলভিত্তিক চেম্বারগুলোর মধ্যে গুরুত্বের ভিত্তিতে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক পদ ভাগ করে দেয়া হয়েছে। খাতভিত্তিক এ্যাসোসিয়েশন ও আঞ্চলিক চেম্বারগুলোর প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক নির্বাচন করে দেবে। এদের ভোট দেবে সাধারণ পরিষদের সদস্য অথবা নিজস্ব সদস্যরা। এই নির্বাচিত ৬০ জন পরিচালকের মধ্য থেকে পরবর্তীতে সভাপতি, প্রথম সহসভাপতি ও ২ জন সহসভাপতি পদে নির্বাচন হবে। যে গ্রুপ থেকে সভাপতি নির্বাচন হবে ওই গ্রুপের সভাপতিসহ ৬০ পরিচালক গোপন ভোটের মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচন করবে। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনে দেশের ব্যবসায়ী নেতারা এফবিসিসিআই নির্বাচনে সভাপতি ও সহসভাপতি এবং পরিচালকের পদগুলোতে সরাসরি ভোট চেয়ে আসছেন। ব্যবসায়ীদের এ গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় দাবি পূরণের জন্য নির্বাচন পদ্ধতিতে আমূল সংস্কার হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংগঠনটির সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এফবিসিসিআইতে খাত ও অঞ্চলভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব থাকা জরুরী হয়ে পড়ছে। ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছেন। অবশেষে এবার নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যেহেতু এফবিবিসিআই এ্যাপেক্স বডি হিসেবে কাজ করছে, তাই এখানে যোগ্য নেতৃত্ব নিয়ে আসতে হবে। অনেক শিল্প খাত আছে যারা অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে কিন্তু এফবিসিসিআইতে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না। অনেক অঞ্চলও অবহেলিত। যদিও অর্থনৈতিক পলিসি নির্ধারণে এফবিসিসিআইয়ের ভূমিকা অপরিসিম। শুধু তাই নয়, দেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে বাজেট। সরকারের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বড় ভূমিকা পালন করছে। এই বাস্তবতায় দেশের বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে সর্বত্র যোগ্য নেতৃত্ব চাই। আর এ কারণেই রিফর্ম বা সংস্কার প্রয়োজন। পরিচালক ও সহসভাপতির সংখ্যা বাড়ছে ॥ বর্তমান এফবিসিসিআইয়ের পর্ষদে পরিচালকের সংখ্যা হচ্ছে ৫২ জন। এর মধ্যে এ্যাসোসিয়েশন আর চেম্বার গ্রুপ থেকে নির্বাচিত হবেন ১৬ জন করে ৩২ জন পরিচালক। এর বাইরে ২০ জন পরিচালক সরকার মনোনীত হবেন এ্যাসোসিয়েশন-চেম্বার থেকে। তবে এবার এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০ জন করার প্রস্তাব করা হবে। বর্তমান বিধান অনুযায়ী ১২টি এ্যাসোসিয়েশন ও ১২টি চেম্বার হতে মনোনীত পরিচালক হিসেবে যারা বোর্ডে প্রতিনিধিত্ব করবেন তাদের আলাদা গুরুত্বপূর্ণ খাত বা অঞ্চলে বিবেচনা করে ‘এ’ ক্যাটাগরি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধরনের ক্যাটাগরির পরিচালকগণ নিজ নিজ গ্রুপের সকল সাধারণ পরিষদ সদস্য দ্বারা নির্বাচিত হবেন। বাকি ১৮+১৮=৩৬ জন পরিচালক চেম্বার ও এ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের স্ব-স্ব ক্লাস্টারের প্রার্থী হিসেবে স্ব-স্ব গ্রুপের সকল সাধারণ পরিষদের সদস্যদের দ্বারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। ১২টি এ্যাসোসিয়েশন ও ১২টি চেম্বার (বর্তমান যারা মনোনীত পরিচালক ক্যাটাগরিতে আছে) প্রত্যেকের জন্য ১টি করে পরিচালক পদ নির্ধারিত থাকবে। এসব সংগঠনের এফবিসিসিআইতে বার্ষিক চাঁদার পরিমাণ অন্যান্য সংগঠনের চেয়ে ৪ গুণ বেশি এবং সাধারণ পরিষদ রেজিস্ট্রেশন ফি ৪ গুণ বেশি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সকল সমিতি ও চেম্বারের ক্ষেত্রে পরিচালক পদে মনোনয়ন ফি ৪ গুণ বেশি করা হবে। এছাড়া এবার সহসভাপতি (ফাইন্যান্স) নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে সভাপতি যে গ্রুপ থেকে নির্বাচিত হবেন সহসভাপতি ফাইন্যান্সও সেই গ্রুপ থেকে নির্বাচনের বিধান করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সংস্কার প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত করে আনা হয়েছে। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে মনোনীত পরিচালকদের বোর্ডে নিয়ে আসার একটি কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনায় এদের একেবারে বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। সংগঠনটির সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ বলেন, মনোনীত পরিচালক প্রথা একেবারে তুলে দিয়ে সরাসরি নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া অঞ্চলভিত্তিতে পরিচালক নির্বাচনেও চেম্বারের সংখ্যার বিষয়টা বিবেচনায় রাখতে হবে। ঢাকা জেলা বড় অঞ্চল ও বেশি সংখ্যক চেম্বার নিয়ে গঠিত। তাই এখান থেকে বেশি সংখ্যক পরিচালক বোর্ডে নিয়ে আসতে হবে। তবে গাইবান্ধা চেম্বারের সভাপতি শাহজাদা আনোয়ার কাদের জনকণ্ঠকে বলেন, সকল পদে সরাসরি নির্বাচন হলেই যোগ্য নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। সংস্কারের মাধ্যমে সকল পদে সরাসরি নির্বাচন দেয়া হোক। কোন অঞ্চল যাতে বৈষম্যের শিকার না হয় সে বিষয়টিও সংস্কারে প্রস্তাবে থাকতে হবে। ভোটার তালিকা সংশোধন হচ্ছে ॥ এফবিসিসিআইয়ের আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ভোটার তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। নাম সর্বস্ব বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোকে বাদ দেয়া হবে। যেসব সংগঠন সংঘবিধি অনুযায়ী নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা, নির্বাচন ও অডিট সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে তাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি মোঃ সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, সংস্কারের আগে ভোটার তালিকা সংশোধন করা হবে। তিনি বলেন, সরাসরি ভোটের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব আসুক সেটাই সবার চাওয়া। তবে এফবিসিসিআইতে বহু ভুয়া সংগঠন ও ভোটার রয়েছে তাদের আগে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এখানে নামসর্বস্ব সংগঠনের কোন জায়গা নেই।
×