শংকর কুমার দে ॥ মোস্ট ওয়ান্টেড পলাতক পুরস্কার ঘোষিত দুর্ধর্ষ জঙ্গীদের হদিস মিলছে না। তারা কোথায় এই বিষয়ে তথ্যও পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার ঘটনায় আলোচনায় এসেছে নব্য জেএমবির। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মোস্ট ওয়ান্টেড পলাতক জঙ্গীরা কোথায় তার খোঁজ করছে। পুলিশ সদর দফতরে মোস্ট ওয়ান্টেড পলাতক ৫০ জন দুর্ধর্ষ জঙ্গীর জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে। এছাড়াও গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার আগে তামিম চৌধুরী আইএস’র অনুমতি নিয়েছিল- রয়টার্সে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদনের বিষয়ে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য নেই, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) প্রায় সাত মাস আগে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ছয় সদস্যকে ধরিয়ে দিতে ১৮ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ছয়জনের মধ্যে শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ এবং সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২-এর জন্য পাঁচ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। বাকি চারজনের প্রত্যেকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয় দুই লাখ টাকা। ওই চারজন হলো সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান ওরফে সাদ, শিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল এবং সাজ্জাদ ওরফে সজিব ওরফে সিয়াম ওরফে শামস।
পুরস্কার ঘোষিত পলাতক এসব জঙ্গীরা ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক হত্যাকা-ে জড়িত বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। এদের মধ্যে শিহাবকে গত ১৬ জুন উত্তরা বিমানবন্দর সড়ক থেকে আটক করে পুলিশ। শরীফ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে গত ২৬ জুন ডিএমপির পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী নাঈম ওরফে সাইফুল ওরফে সাদ (৩০) ও সোহায়েল ওরফে শোভেলকে (২৮) গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা ব্লগার হত্যা মামলায় ওয়ান্টেড। পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ জঙ্গীর মধ্যে গত ২ আগস্ট গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ জিয়াউল হক ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ করে ৪০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশের জঙ্গীবিরোধী অভিযানে দুই সহযোগীসহ তামিম আহমেদ চৌধুরী নিহত হয়। চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার এখনও হদিস নেই। হদিস নেই গুলশান হামলার ঘটনায় অপারেশন কমান্ডার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল ইসলাম মারজানেরও। এছাড়াও ব্লগার ও লেখক অভিজিত-দীপন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী সেলিমকে ধরিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য আল ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতা সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২। তাকে ধরিয়ে দিতে লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানের পুলিশ হত্যা করে শীর্ষ জঙ্গী নেতা মৃত্যুদ-ে দ-িত সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি ও রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ এবং যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গীরা। পরে টাঙ্গাইলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন হাফেজ মাহমুদ। বোমারু মিজান ও সালাউদ্দিনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও হদিস মিলছে না।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানান, পুলিশ সদর দফতর ও র্যাবের পক্ষ থেকে জঙ্গীদের তথ্য প্রদানে পাঁচ লাখ টাকা ও আত্মসমর্পণকারী জঙ্গীদের জন্য ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েক জঙ্গী আত্মসমর্পণ করলেও পলাতকদের বেশিরভাগই আত্মসমর্পণ না করে আত্মগোপনে রয়ে গেছে। রাজধানীর গুলশানে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর নিখোঁজ তরুণদের মধ্যে আছেন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান, বাড্ডার জুনায়েদ খান, ঢাকার আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম, ঢাকার ইব্রাহীম হাসান খান, ধানম-ির জুবায়েদুর রহিম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নজিবুল্লাহ, সিলেটের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি, জুনুন শিকদার, গ্রামীণফোনের সাবেক কর্মকর্তা তাহমিদ রহমান শফি, আইবিএর সাবেক ছাত্র তৌসিফ হাসান ও প্রয়াত মেজর (অব) ওয়াসিকুর রহমানের ছেলে আরাফাত ওরফে তুষার।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, পলাতক বা নিখোঁজদের গণমাধ্যমে যাদের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের অনেকের বিষয়েই তথ্য পাওয়া গেছে। কারও কারও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাও পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আশা করি, দ্রুতই কেউ কেউ গ্রেফতার হবে।
আইএসের অনুমতি সংক্রান্ত পুলিশের কাছে তথ্য নেই ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আগে তামিম চৌধুরী আইএস’র অনুমতি নিয়েছিল- রয়টার্সে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদনের বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য নেই, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় আইএসের অনুমোদন নিয়েছিলেন তামিম চৌধুরীর বার্তা সংস্থা রয়টার্সেও এমন একটি প্রতিবেদন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ মন্তব্য করেন ডিএমপি কমিশনার। ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘এই বিষয়টি আমাদের গোয়েন্দারা অনুসন্ধান করছে, তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।’ শনিবার দুপুরে ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে সংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন ডিএমপি কমিশনার। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক দুই কোটির টাকার চেক হস্তান্তর করে কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে। চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠানেই সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন ডিএমপি কমিশনার। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এ কে এম শিরিন, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন) মোঃ শাহাব উদ্দিন কোরেশী, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটি) মোঃ মনিরুল ইসলামসহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, গত ১ ডিসেম্বর ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক বিশেষ প্রতিবেদনে দাবি করেছে, গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার পরিকল্পনায় আইএসের (ইসলামিক স্টেট) অনুমোদন নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন হামলার মূল হোতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরী। আইএসের অনুমোদন পাওয়ার পর তিনি গুলশানে হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তার পরিচয় গোপন করে রয়টার্স এই দাবি জানিয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘হলি আর্টিজানের ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম। এটি সত্য যে সে সময় কেবল আমরা শুধু নই, পুরো জাতি এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। হলি আর্টিজান আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এরপরই আমরা কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট গঠন করেছি, আমাদের নিরাপত্তা কর্মকা- ঢেলে সাজিয়েছি। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্ব যা করতে পারেনি, সেখানে আমরা ১০০ দিনের মাথায় জঙ্গীর লাগাম টেনে ধরেছি। তিনি বলেন, আমরা দাবি করি এখন আমরা সক্ষম। তবে অপরাধমুক্ত সমাজ কখনই কল্পনা করা যায় না, কখনও ছিল না। আমরা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছি কিংবা সমূলে উৎপাটন করার চেষ্টা করছি।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির নেতা মারজান, বাশার, রাজিবসহ বিভিন্ন সদস্য যারা পলাতক রয়েছে, তাদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। নিরাপত্তা বাড়লেই দেশের বিনিয়োগ বাড়বে আর বিনিয়োগ বাড়লে দেশ এগিয়ে যাবে। দেশে টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি হলে বিনিয়োগে বাধাগ্রস্ত হবে। আর বিনিয়োগে যাতে কোন বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্য পুলিশ কাজ করছে। অপরাধ প্রতিরোধ একটি চলমান প্রক্রিয়া। হলি আর্টিজানের পর একাধিক অভিযান হয়েছে। আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করছি। এখনও জঙ্গীদের কিছু সহযোগী বাইরে রয়েছে, তাদের ধরার জন্য অভিযান চলছে। তবে আমরা মনে করি না, বড় কোন ধরনের নাশকতা ঘটানোর সক্ষমতা তাদের রয়েছে।