ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজিবির জোরদার টহল সত্ত্বেও থামছে না অনুপ্রবেশ

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ভিটায় গড়ে তোলা হচ্ছে রাখাইন বসতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ভিটায় গড়ে তোলা হচ্ছে রাখাইন বসতি

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ মিয়ানমারে মংডু উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম বর্তমানে জনমানবশূন্য এলাকায় পরিণত হয়েছে। মাত্র দেড় মাস আগেও ওই সব গ্রামে বাড়িঘর ও জনবসতি ভরপুর ছিল। ঘরগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাশূন্য করে বর্তমানে ওই সব ভিটায় স্থানীয় প্রশাসনের মদদে ন্যাটুল্যাপাড়া (রাখাইন পরিবার) বসানো হচ্ছে। বিজিবির টহল জোরদার থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ থেমে নেই। এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি মাছিবরপাড়ার তিন আদিবাসী যুবককে ধরে নিয়ে গেছে আরএসও। অপহরণের দুই সপ্তাহ পরও ফেরত দেয়নি তাদের। উপজাতি ওই তিন যুবককে উদ্ধার করতে স্বজনরা থানায় জিডি ও প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ১৪ দিন ধরে। গত ২০ নবেম্বর তারা মামা-ভাগিনার ঝিরিতে মাছ শিকার করতে গিয়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটি ছাড়া করে ওই সব স্থানে রাখাইনপাড়া বসাতে উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির স্থানীয় প্রশাসন। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতন সইতে না পেরে দলে দলে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু নাফ নদী পাড়ি দিতে চেষ্টা চালাচ্ছে এখনও। সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে অনুপ্রবেশকারীরা কেউ শরণার্থী ক্যাম্প ও বস্তিতে আবার কেউ শহরসহ জেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়স্বজনের (রোহিঙ্গা) বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেয়া লোকজন হতদরিদ্র পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশু। গত কয়েক দিনে অনুপ্রবেশকারী পরিবারগুলোতে বিত্তশালী কোন পরিবার নেই বললেই চলে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে লোকালয়ে বিভিন্ন স্থানে মিশে গেছে। গত কয়েক দিনের অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কারণে জেলার প্রতিটি বাজারে তরকারির দাম ক্রেতা সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে মিয়ানমার অভ্যন্তরে পাহাড়ে আরএসওর ঘাঁটিতে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া তিন উপজাতি যুবকের বাড়িতে স্বজনদের কান্নার রোল পড়েছে। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের ওই ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে আরএসও বাংলাদেশের সমন্বয়কারী টেকনাফ থানার পলাতক আসামি আরএসওর অস্ত্র প্রশিক্ষক রোহিঙ্গা মাস্টার আয়ুব। নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় এন্ট্রিকৃত ডায়েরি (নং-১০২৩) সূত্রে জানা যায়, দুই সহোদর মংহ্লাচিং মার্মা (৪১), থুইহ্লামং মার্মা (৩২) ও একই পাড়ার প্রতিবেশী মৃত ক্রোথোয়াইয়ের পুত্র ক্যাছিং থোইয়া (২২) ২০ নবেম্বর সকালে পার্শ্ববর্তী বাঁকখালী খালের শাখা-প্রশাখার দোছড়ি এলাকার মামা-ভাগিনার ঝিরিতে মাছ শিকার করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সন্ধ্যা পর্যন্ত ফিরে না আসায় বাদী চাই সুইচিং ও গ্রামবাসী সম্ভাব্য স্থানে খোঁজাখুঁজি করে জেনেছেন ওই তিন যুবককে আরএসও ক্যাডাররা অপহরণ করেছে। পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ হাবিবুল্লাহকে বিষয়টি অবগত করেন স্বজনরা। এছাড়াও দুই সহোদরসহ তিন যুবককে উদ্ধারপূর্বক পরিবারের নিকট ফেরত দেয়ার দাবিতে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে বৃহস্পতিবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে আবেদন করেছেন চাই সুইচিং মার্মা। ওই আবেদনেও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনকে (আরএসও) দায়ী করা হয়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তামাক চাষী ফরিদ আলম বলেন, উপজাতি তিন যুবক ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টায় ঝিরিতে মাছ ধরছিল। কিছুক্ষণ পর পাহাড় থেকে ৫-৬ জন অপরিচিত ব্যক্তি এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে এদের অনুসন্ধানরত গ্রামবাসী মামা-ভাগিনা ঝিরির ভেতর গেলে জীবনের হুমকি আছে জানিয়ে অপহৃতদের ওই সব স্বজনকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী আরএসওর অপতৎপরতায় এর আগেও একাধিক উপজাতি যুবককে ধরে নিয়ে গুম করে ফেলেছে। নাইক্ষ্যংছড়ি সদর চাকঢালাপাড়ার আথোয়াই চাক, চাচিং চাক ও পাইনছড়িপাড়ার মৃত ক্রাহ্লাঅং মার্মার পুত্র উহ্লামং মার্মাকে জুন মাসে ক্রোক্ষ্যং রাস্তায় মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে প্রকাশ্য দিবালোকে আরএসও জঙ্গীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। তার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনও জানা যায়নি। ১৬ নবেম্বর চেনথুই চাকের পুত্র অংচিংথোয়াই চাক (৩৬) গর্জনিয়া বাজার হতে বাড়ি ফেরার পথে ধলুঝিরি সেগুন বাগানে পৌঁছলে অপরিচিত ৭-৮ জন লোক ঘেরাও করে রাখে। তাদের কানাঘুষা ও কথাবার্তায় সন্দেহজনক হলে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার কথা বলে কৌশলে পালিয়ে আসে। ১৯৮১ সাল দোছড়ি ইউনিয়নের উক্যজাই হেডম্যানপাড়া মৃত অংক্যজাই মার্মার পুত্র থোয়াইম্রাউ মার্মা (২২), মৃত চিংপ্রু মার্মার পুত্র ক্রাইখ্যাইরি মার্মা (২০), মৃত মংছাক্রো মার্মার পুত্র থোয়াইস্রাঅং মার্মাকে (১৮) মাছ শিকার করার সময় অপহরণ করেছিল। ২০০০ সালে দোছড়ি ক্রোক্ষ্যং চাকপাড়া থেকে যাওয়ার পথে মামা ভাগিনা ঝিরিতে অপহরণ করে আরএসও ক্যাডাররা খুন করে চাকঢালাপাড়া আথোয়াই চাক ও পুত্র চাচিং চাককে (২০)। গত ৯ অক্টোম্বর প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে সৃষ্ট ঘটনার পর থেকে অপরিচিত রোহিঙ্গা জঙ্গীদের দোছড়ি এলাকার আনাগোনা বেড়েছে বলে স্থানীয় মার্মা, চাক ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা জানিয়েছেন। দোছড়ির মাছিবরপাড়ার মংহ্লাচিং মার্মা (৪১), থুইহ্লামং মার্মা (৩২), প্রতিবেশী মৃত ক্রোথোয়াইয়ের পুত্র ক্যাছিং থোইয়া মার্মা (২২), উক্যজাই হেডম্যানপাড়ার মৃত অংক্যজাই মার্মার পুত্র থোয়াইম্রাউ মার্মা (২২), মৃত চিংপ্রু মার্মার পুত্র ক্রাইখ্যাইরী মার্মা (২০), মৃত মংছাক্রো মার্মার পুত্র থোয়াইস্রাঅং মার্মা (১৮), পাইনছড়িপাড়া মৃত ক্রাহ্লাঅং মার্মার পুত্র উহ্লামং মার্মা (৩০) এবং নাইক্ষ্যংছড়ি সদর চাকঢালাপাড়া আথোয়াই চাক ও পুত্র চাচিং চাকদের উদ্ধার তৎপরতা বৃদ্ধি করতে স্বজনরা উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। রাখাইনদের মানববন্ধন ॥ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যাকা- ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতিবাদে মহেশখালীর বৌদ্ধভিক্ষুসহ রাখাইন সম্প্রদায় মানববন্ধন করছে। শনিবার দুপুরে মহেশখালী উপজেলা চত্বরে রাখাইনদের এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধভিক্ষুরা বলেন, বেড়েই যাচ্ছে মিয়ানমারে বর্বরোচিত অত্যাচারের পাশাপাশি নির্মম হত্যাকা-। মানুষের বিবেকের কোন ধর্ম থাকে না, মানবতার কোন সীমা থাকে না, মানুষ মানুষের জন্য বিবেক জেগে ওঠবেইÑ এটাই প্রকৃত ধর্ম। ‘পৃথিবীর সকল মানুষে মানুষে ভাতৃত্ব গড়ি’ সেøাগানে মুখরিত হয়ে মহেশখালীতে বসবাসরত পৌরসভার বড় রাখাইনপাড়ার রাখাইনসহ সকল সম্প্রদায়ের লোক সম্প্রীতিতে সহমর্মিতায় রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন গড়ে তোলেন। এতে প্রধান অতিথি স্থানীয় সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক, বিশেষ অতিথি কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা ও সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও রাখাইন সম্প্রদায়ের নেতা বুড়ি মারমা, চাচিং মারমা, মংলাপ্রধানসহ রাখাইন নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশী তিন দালাল মিয়ানমারে আটক ॥ মিয়ানমারে সহিংসতার ঘটনায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সীমান্ত থেকে এগিয়ে আনতে গিয়ে বাংলাদেশের তিন দালাল ধরা পড়েছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) হাতে। এরা হচ্ছেÑ টেকনাফ সদর বরইতলীর মোঃ শফির পুত্র মোঃ উল্লাহ, জকির প্রকাশ আলী জোহারের পুত্র মোঃ সাদেক ও আমানুল্লাহর পুত্র মোঃ সেলিম। সেলিমের পিতা আমান উল্লাহ জানান, বুধবার রাতে জেলে বেশে নৌকা নিয়ে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে রোহিঙ্গা আনতে ওপারে যায়। সেখানে নৌকাসহ তারা মিয়ানমারের বিজিপির হাতে আটক হয়। সাদেকের মা জুহুরা বেগম জানান, মিয়ানমারের দালাল মারফত সংবাদ পেয়েছেন বুধবার সেখানে তাদের মিয়ানমারের বিজিপি আটক করে মংডুতে নিয়ে গেছে। ২২ রোহিঙ্গাকে ফেরত ॥ নাফ নদীর বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকালে রোহিঙ্গাবোঝাই দুটি নৌকা ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। বিজিবির টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের উপঅধিনায়ক মেজর মোঃ আবু রাসেল সিদ্দিকী বলেন, নাফ নদীর জাদিমুরা পয়েন্ট দিয়ে শনিবার ভোরে ২টি নৌকায় করে অন্তত ২০ জনের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। ওই সময় বিজিবির টহল দলের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি কড়া নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। শনিবার ভোরে বিজিবির টহল দল সীমান্তের উখিয়ার বালুখালী পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকালে দুই রোহিঙ্গা নারীকে ফেরত পাঠিয়েছে। কাজের সন্ধানে রোহিঙ্গারা ॥ মানবিক দিক বিবেচনা করে স্থানীয়রা তাদের সহযোগিতা করলেও অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি বানানোর জন্য পাহাড় কেটে সাবাড় করা ছাড়াও তারা এখন কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনসহ নানান সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারা। কক্সবাজার এমনিতেই রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা। রোহিঙ্গারা তাদের স্বজনের কাছে এসে আশ্রয় নিয়ে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে। স্থানীয় সর্দার হাজী গোলামুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি আমাদের মানবিকতা আছে, কিন্তু দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে আমরা সেই মানবিকতা ততবেশি দেখালে আমাদের কী অবস্থা হবে? উখিয়া-টেকনাফ ছাড়াও কক্সবাজারে রোহিঙ্গারা যে হারে অবস্থান-আশ্রয় নেয়া শুরু করেছে, কয়েক দিন পরই তাদের বোঝা সইতে হবে স্থানীয়দের। বর্তমানে তরকারির হাটে যাওয়াই মুশকিল। কয়েক দিন আগে যে দামে তরকারি বেচা-কেনা হয়েছে, বর্তমানে তা দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা হচ্ছে। তরকারি বিক্রেতারা জানান, বর্তমানে লোকজন বেশি, তাই চাহিদা অনুপাতে দামও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
×