ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযোদ্ধা ছাইদুরের সাক্ষাতকার

‘আমরা আখক্ষেত ঘিরে ফেলি, ভেতরে আটকা পড়ে পাক আর্মি’

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

‘আমরা আখক্ষেত ঘিরে ফেলি, ভেতরে আটকা পড়ে পাক আর্মি’

এমদাদুল হক তুহিন ॥ আমরা আখ ক্ষেতের চতুর্দিক ঘিরে ফেলি। ভেতরে আটকা পড়েছে পাকি আর্মি। সহযোদ্ধাদের বলা হলো যখন গুলি ছোড়া হবে, তা হবে একমুখী। অর্থাৎ উত্তর থেকে গুলি করলে উত্তর থেকেই। আবার দক্ষিণ থেকে গুলি করলে কেবল দক্ষিণের। এভাবে গুলি চলতে থাকল। তুমুল যুদ্ধ। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা পর সব শুনশান। নীরব। অনেকটা নিস্তব্ধ। আমরা এগিয়ে গেলাম। ভেতরে পড়ে থাকতে দেখলাম একাধিক আর্মির মৃতদেহ। সেখানে যুদ্ধ শেষে আমি এক পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনের ক্যাপ পাই। এটা আমার কাছেই ছিল। যুদ্ধের পরে কয়েকদিন মাথায় দিয়ে ঘুরেছি। পরে অস্ত্রের সঙ্গে ক্যাপও জমা দিয়ে দিই। সেখানে থেকে যে আর্মিরা বাঁচতে পারে তারা গরুর গাড়িতে চড়ে ফিরে যাচ্ছিল। তারা কিছু লাশ নিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তায় এসে দেখতে পাই চারদিকে রক্ত। গরুর গাড়ি থেকে রক্ত পড়তে থাকার চিহ্ন। এর দশ বারো দিন পরেই দেশ স্বাধীন হয়। মূলত আমাদের নেতৃত্বে দক্ষিণ গফরগাঁওয়ের কয়েকটি এলাকা পাকি মুক্ত হয়।’- মহান বিজয়ের মাসে কয়েকটি সফল অভিযানের কথা জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা ছাইদুর রহমান। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কুকশাইর গ্রামের এই মুক্তিযোদ্ধা নিজ এলাকার বাইরেও কয়েকটি সফল অভিযানে অংশ নিয়েছেন। সিলেটের মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর ও হোসেপুরে তাদের সফল অভিযানে ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে পাকি অর্মিরা। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপে তার কণ্ঠে ভারি হয়ে আসছিল। থেমে যাচ্ছিলেন বারবার। সফল হয়েছেন যেমন, স্মৃতির পাতা উল্টে বললেন ব্যর্থ অভিযানের কথাও। যুদ্ধের প্রথমদিকে নিজ এলাকায় একটি অভিযানে অংশ নিয়ে হারিয়েছেন একাধিক সহযোদ্ধাকে। বললেন, সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান ভাগ্যক্রমে। ঠিক কবে যুদ্ধে গেলেন এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা ছাইদুর রহমান বলেন, ‘সময় তখন আগস্ট। আমরা কয়েক জন একসঙ্গে আগরতলা যাই। সেখানে সোনারবাংলা ক্যাম্পে থাকতাম। এর আগে পাকিস্তানের আর্মিতে ছিলাম। সোনার বাংলা ক্যাম্পে ভারতীয় আর্মিরা বললেন, এখানে আর্মির কে কে আছে? হাত উঠানোর পর আমাদের নিয়ে গেল ভারতের মরণতলিতে। ওখানে আর্মির ক্যাম্প ছিল। কয়েকদিন ট্রেনিং শেষে অস্ত্র দিয়ে আমাদের দেশে পাঠানো হলো।’ কথা বলতে বলতে তিনি যেন থামছেন না। যুদ্ধে এলে থামতে নেই। তিনি বললেন, ‘প্রথমেই আমরা এলাম সিলেটের মৌলভীবাজারে। আমাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনারাও এলো। সেখান থেকে যুদ্ধ করে মরণতলি চলে গেলাম। ওসমানি সাহেবের কাছে।’ সিলেটের যুদ্ধ সম্পর্কে কিছু বলুন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা সিলেটে পাকিস্তানের ৩০০ আর্মিকে আটক করি। তাদের ধরে ভারতে নিয়ে যাই। একদম ভারতের ভেতরে। তাদের সেখানে নিয়ে হত্যা করি।’ যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা ছাইদুর রহমান বলেন, ‘সিলেটে যুদ্ধ শেষে চলে এলাম কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে। ৬৭ জন লোক এলাম। সেখানে ৫ থেকে ৭ দিন যুদ্ধ হলো। আমরা কুলিয়াচর ব্রিজ উড়িয়ে দিই। ওই অঞ্চল পাকি মুক্ত করে চলে এলাম হোসেনপুরে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা হোসেনপুরে আছি এমন তথ্য জেনে এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে খবর পাঠানো হলো। বলা হলো, এলাকার ছেলে এলাকায় এসে যুদ্ধ করো। সেখান থেকে ফিরে কোম্পানি কমান্ডার ইকবাল-ই-আলম কামালের দলে যোগ দিলাম। এখানে আমরা কামাল কমান্ডারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি।’ ফেরার পথে নিজ এলাকায় কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার ৮ থেকে ১০ দিন আগে আমার সঙ্গে যুদ্ধ হয় গয়েশপুরে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা মারা যান ৭ জন। সবাই হতাশ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে পেছনে ফিরতে থাকি। হুট করে একটা কুয়ার মধ্যে পড়ে যাই। পাকিরা কুয়ার চারপাশ ঘিরে ফেললেও আমাকে আর খুঁজে পায়নি। তখন গভীর রাত। হয়ত ১০ কিংবা ১১টা। আমি কুয়া থেকে উঠে আসি। কুয়া থেকে উঠামাত্রই অল্পদূরে দেখি কাঁটা তারের বেড়া। দৌড়ে পালিয়ে আসার সময় কাঁটা তার শরীরে লেগে মাংস ছিঁড়ে যায়। গিয়ে একটা নদীতে পড়ি। পানিতে ভাসতে থাকি। তখন এলাকায় এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্থানীয়রা পাহারা দিত। নদীতে ভেসে যাওয়ার সময় আমার মাথা দেখে রক্ষীবাহিনী আটকাল। তখন আমি এলএমজি চালাতাম। তা পানির ওপর উঠিয়ে ধরি। মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চিত হওয়ার পর তারা আমাকে নদী থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। অনেকটা পাতাল কোলে করে। তখন শরীরে কোন কাপড় নেই।’ তিনি বলে যাচ্ছেন। বললেন, ‘এদিকে এলাকায় আমার কোন খরব নেই। বাড়িতে খবর হয়েছে আমাদের অনেক সহযোদ্ধা মারা গেছে। মেরে ফেলা হয়েছে অনেককেই। আমার বাড়িতে ছিল একমাত্র মা। তিনি কান্নাকাটি করছেন। আমিই একমাত্র সন্তান। বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।’ এলাকায় ছাইদ মাস্টার নামে পরিচিত এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘দক্ষিণপাড়া আসার পর জানতে পারি, কান্দিপাড়া বাজারে হামলা করেছে পাকবাহিনী। ওখানে দাঁড়িয়ে গুলি ছুড়ে আমি ফাঁকা আওয়াজ করি। কিন্তু ওরা গুলি করছিল বৃষ্টির মতো। পরে পিছু হটে ওরা বাঘেরগাঁও এর দিকে ঢুকছিল। চারদিক থেকে আমরা ঘিরে ফেলি। কন্নাম-ল ও নয়াবাড়ি সীমান্তে একটা আখক্ষেতে পাকি আর্মিরা আশ্রয় নেয়। চারদিকে আমাদের সহযোদ্ধা। নির্দেশ দেয়া হলো একমুখী গুলির। দীর্ঘ সময় শেষে সবকিছু শুনশান, নিস্তব্ধ। আমাদের গুলিতে পাকি ক্যাপ্টেন মারা গেল। ওরা গরুর গাড়িতে চড়ে ফিরে যাচ্ছিল। তারা কিছু লাশও নিয়ে গেল। রাস্তায় এসে দেখতে পাই চারদিকে রক্ত। গরুর গাড়ি থেকে রক্ত পড়তে থাকার চিহ্ন। এর দশ বারো দিন পরেই দেশ স্বাধীন হয়।’ এভাবেই মুক্ত হয় দক্ষিণ গফরগাঁও এর বড় একটি অংশ। পাকিমুক্ত হয় কান্দিপাড়া, বাঘেরগাঁও, কন্নাম-ল ও নয়াবাড়ি। যুদ্ধের এতেবছর পর সমাজে কতোটা মূল্যায়িত হচ্ছেন এমন প্রশ্নে এই মুক্তিযোদ্ধার উত্তর, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মানুষ ভাল সম্মান দেখায়। এক কথায় ভালভাবেই মূল্যায়িত হচ্ছি। বর্তমান সরকার আমাদের সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করছে। আমরা যা চাই, সরকার তা শুনছে।’
×