ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রথম তদন্ত রিপোর্টে কারণ উল্লেখ হয়নি

বুদাপেস্টগামী ফ্লাইটের নাট ঢিলা থাকার রহস্য আরও ঘনীভূত

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

বুদাপেস্টগামী ফ্লাইটের নাট ঢিলা থাকার রহস্য আরও ঘনীভূত

আজাদ সুলায়মান ॥ প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বুদাপেস্টগামী ফ্লাইটের নাট ঢিলা থাকার রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এ ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটির একটির প্রতিবেদন ইতোমধ্যে দাখিল হলেও তাতে নাট ঢিলা হওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়নি। বাকি দুটো তদন্ত কমিটির সদস্যরাও এখনও নিশ্চিত হতে পারছেন না কেন নাট ঢিলা হলো? ঢাকা থেকে বুদাপেস্ট যাওয়ার পথে ওই ফ্লাইটের অয়েল প্রেসার কমে যাওয়ায় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ায় তুর্কমেনিস্তানে জরুরী অবতরণ করে ‘রাঙ্গা প্রভাত’। জরুরী অবতরণের আগে তা ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রীকে তা তাৎক্ষণিক ব্রিফ করা হয়- এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আকাশ পথে এমনটি হতেই পারে। বিমান প্রকৌশল শাখার প্রধান প্রকৌশলী দেবেশ চৌধুরীর অয়েল প্রেসার কমে যাওয়ার ব্যাখ্যায় উদারচিত্তের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কনভিন্স হয়ে এ ঘটনাকে স্বাভাবিক মেনে নেন। কিন্তু এ সংবাদ মুহূর্তেই দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষ যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তিনি সুস্থভাবে দেশে ফিরে এলেও মানুষের কৌতূহল এখনও দূর হয়নি। বিমান শুরু থেকেই বলে আসছে- ইঞ্জিনে অয়েল প্রেসার কমে যাবার কারণেই যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় এবং জরুরী অবতরণে বাধ্য হন ক্যাপ্টেন ইসমাইল। তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাদ বিমানবন্দরে ওই ফ্লাইটের অয়েল প্রেসার সিস্টেমের নাট টাইট দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন তার লগ বুকে সুস্পষ্টভাবে লেখেন- ‘ফাউন্ড ওয়ান নাট লুজ’। লগ বুকের এই নাট লুজের বিষয় কেন্দ্র করেই এখন চলছে সব তদন্ত কমিটির কাজ। নাট ঢিলা হওয়া নিয়ে কোন বিতর্ক বা সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই নাট লুজ বা ঢিলা হলোÑ মূলত এই প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করছে এটা নাশকতা নাকি স্রেফ যান্ত্রিক ত্রুটি? এ সম্পর্কে গত কদিন ধরেই বিমান বলে আসছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নাট লুজ হবার কারণ বলা যাবে না। যদিও একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উল্লেখই করা হয়নি। বিমান এখন বাকি দুটো তদন্তের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ বলেছেন, প্রাথমিক তদন্তে বিষয়টি পরিষ্কার না হলেও বাকি দুটো তদন্তে এটা পরিষ্কার হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এদিকে বোয়িং ৭৭৭ রাঙ্গা প্রভাতের মতো একটা ব্র্যান্ড নিউ উড়োজাহাজের নাট কেন লুজ বা ঢিলা হবে তা ভাবিয়ে তুলেছে বিমানের শীর্ষ এরোন্যটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদেরও। বিমানের প্রকৌশল শাখার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অয়েল প্রেসার সিস্টেমে নাট লুজ বা ঢিলা হবার কোন কারণই নেই। এ নাটে হাত দেয়ারই প্রয়োজন পড়ে না কখনও। তারপরও এ নাট লুজ হয়ে যাবার বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। ঘটনার পর বিমান থেকে বোয়িং কোম্পানিকে এটা জানানোর পর সেখানকার বিশেষজ্ঞরাও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষায়, অয়েল প্রেসার সিস্টেমের নাটে কোন ধরনের সংস্কার, ঘষা মাজা বা মেরামত করার মতো কোন কাজ থাকে না। সাধারণত এ নাটে কোন ধরনের সাইক্লিং আওয়ারও থাকে না। অন্যান্য ইউনিটের নাট বল্টু বা যন্ত্রাংশের সাইক্লিং আওয়ার থাকায় একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর সেগুলো বদলানো বা রিপ্লেসমেন্ট করাটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ নাটের বেলায় তেমনটি বাধ্যবাধকতা নেই। এ জন্যই উড়োজাহাজ নির্মাণের পর থেকে বছরের পর বছর ধরে এ নাটে কোন ধরনের স্পর্শ ছাড়াই স্বাভাবিক থাকে। অথচ বিমানে ‘রাঙ্গা প্রভাত’ যুক্ত হবার মাত্র দু’বছরের মাথায় এ নাট কেন লুজ হয়ে পড়েছে সেটারই হিসাব মেলাতে পারছে না বিমানের প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা। তাদের উদ্বেগের কারণটা এখানেই। এ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রকৌশল শাখার বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন-স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর (এসওপি) অনুযায়ী রাঙ্গা প্রভাত ২৭ নবেম্বর ভিভিআইপি ফ্লাইট হিসেবে আকাশে ওড়ার চব্বিশ ঘণ্টা আগেই হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমানের নিজস্ব হ্যাঙ্গারে নেয়া হয়। এখানে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রেখেই সর্বশেষ ফিট চেক লিস্ট করা হয়। বিমান সূত্র জানায়, আকাশে ওড়ার আগে সর্বশেষ চেকের সময় বিমানের নিজস্ব এ্যারোনটিক্যাল প্রকৌশলীরাই ওই অয়েল প্রেসার সিস্টেমের পাশের ইলেক্ট্রিকাল সিস্টেমে কাজ করে। সেখানে কাজ করার সময় ইচ্ছাপূর্বক বা অনিচ্ছাপ্ূর্বক কেউ ওই নাটে হাত দিয়েছিল কিনা এখন সেটাই তদন্তের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ টেনে অপর এক প্রকৌশলী জনকণ্ঠকে বলেন, পাঁচ বছর আগে আনা পালকি ও অরুণ আলোর অয়েল প্রেসার সিস্টেমের নাট এখনও সেই আগের মতোই অটুট আছে। বিন্দুুুমাত্র যান্ত্রিক ত্রুটি বা পরিবর্তন না ঘটায় এখনও সেটা আনটাভ রয়ে গেছে। উড়োজাহাজ নির্মাণের পর থেকেই বছরের পর বছর ধরে এ নাট স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু মাত্র দু’বছর আগে আনা সর্বশেষ বোয়িং রাঙ্গা প্রভাতের নাট কেন লুজ হবে সেটা গভীর রহস্যের। এখানে মানুষের হাত পড়ার কোন কারণই ছিল না। এ নাট মেইনটেনেন্স আইটেম নয়-যে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর খুলে নতুন করে সংযোজন করতে হয়। তারপরও কেন এতে মানুষের হাত পড়েছে। বিমান নিশ্চিত করেছে-পাশের ইউনিটে কাজ করার অজুহাতেই এখানেও হাত পড়েছে। এখন দেখতে হবে-এই হাত পড়াটা ইচ্ছেপূর্বক নাকি অদক্ষতাজনিত ভুলের খেসারত। এদিকে রাঙ্গা প্রভাতে অয়েল প্রেসার কমে যাওয়ার পর ইলেট্রিকাল চেক লিস্ট-এর ডিকটেড অনুযায়ী ক্যাপ্টেন ইসমাইল কি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেটা বিমান এখনও পরিষ্কার করছে না। বিমানের নিজস্ব ও প্রথম তদন্ত প্রতিবেদনে সেটার উল্লেখ করা হয়নি। বিমানের এক ক্যাপ্টেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, কোন ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে ক্যাপ্টেন ককপিটে তার সামনের মনিটরেই দেখতে পান। এ সময় ইলেক্ট্রিক্যাল চেক লিস্টেই ভেসে ওঠে পরবর্তী করণীয় ইনিডিকেশন, কোন ইঞ্জিন বন্ধ করতে হবে, নিকটতম কোন বিমানবন্দরের জরুরী অবতরণ করতে হবে নাকি হবে না। রাঙ্গা প্রভাতে এ প্রসিডিউর ফলো করা হয়েছে নাকি ক্যাপ্টেন ইসমাইল নিজের খেয়ালখুশি মতো কিছু করেছেন সেগুলো খতিয়ে দেখা জরুরী হলেও তদন্তে সেটা উল্লেখ করা হয়নি।
×