ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

হাঙ্গেরিগামী ফ্লাইট সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী

বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের প্রস্তাব দেয়ার আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল মন্তব্য করে বলেছেন, একটি দলের প্রধান হিসেবে উনি (খালেদা জিয়া) নির্বাচনে না আসার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নির্বাচনে না এসে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের নামে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন, দেশের সম্পদ ধ্বংস করেছেন। তাই কোন প্রস্তাব দেয়ার আগে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার জন্য বিএনপি নেত্রীর জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। আগে জাতির কাছে এর জবাব দিক, তারপর বিএনপি নেত্রীর প্রস্তাবের জবাব দেব। যারা খুনী, সেই খুনীদের বক্তব্যের জবাব কি দেব? আর যে নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে তার কাছে জাতি কি আশা করতে পারে। শনিবার গণভবনে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন, এখন আর মধ্য নেই, মধ্য পার হয়ে গেছে। আমরা তিন বছর পার করছি। মধ্যবর্তী যদি কেউ বলেও থাকেন, সেটা পরবর্তীর বিষয়ে বলেছেন। স্বপ্ন দেখা ভাল। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিএনপি নেত্রীর প্রস্তাব সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, উনার প্রস্তাবের তো আগা-মাথা নেই। ক্ষমতায় থাকতে উনারা (খালেদা জিয়া) নির্বাচন নিয়ে কী খেলা খেলেছেন, তা কী তাদের স্মরণে আছে? নির্বাচন নিয়ে তারা কি খেলেছে তা দেশের মানুষ জানে। এখন উনি নির্বাচন কমিশনের কথা বলেন। এই নির্বাচন কমিশন সরকার থেকে করা হয়নি। এখানে সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন করা হয়েছে। তখন তাদের যা যা দাবি ছিল তা মেনেই এ কমিশন করা হয়। বর্তমানে সেই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে কত মানুষ পুড়িয়ে বিএনপি নেত্রী হত্যা করেছেন তা হিসাব করে দেখুন। উনার (খালেদা জিয়া) প্রস্তাব উনি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিকে বলুক, তিনিই (রাষ্ট্রপতি) যা ব্যবস্থা নেয়ার নেবেন। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই। বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, তার (খালেদা জিয়া) নির্দেশে দেশব্যাপী মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে আগুন দেয়া হয়েছে। এখন তিনি প্রস্তাব দিচ্ছেন! আগে মানুষ হত্যার জবাব দেন, পরে প্রস্তাব নিয়ে কথা হবে। তারা যখন ৫টি সিটি কর্পোরেশনে বিজয়ী হলো তখন তো বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোন কথা বলেননি। তারা যখন নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তখন ইসি ভাল, আর হারলেই খারাপ। নির্বাচনে অংশ নেবে না, আবার বলবে ভাল না। ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯২ দিন দলীয় অফিসে থেকে নির্দেশ দিয়ে দিয়ে বিএনপি নেত্রী জীবন্ত মানুষগুলোকে পুড়িয়ে হত্যা করলেন। উনার পুত্র মারা যাওয়ার পর দেখতে গেলাম। আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঢুকতে দেয়া হলো না। ছোট পকেট দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলে তাও বন্ধ করে দেয়া হলো। এ ধরনের অসভ্যতা ও নোংরামি যারা করে, তারা কী প্রস্তাব দিল বা না দিল আমাদের কিছু করার নেই। আর তার প্রস্তাব নিয়ে এত কথার কী আছে? খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সম্পর্কে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনি (খালেদা জিয়া) পুরনো প্রেম ভুলতে পারেননি। তাই যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী, বঙ্গবন্ধুর খুনীর দল ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছেন। তার প্রস্তাবেই বিএনপির নেত্রীর মনোবাসনার কথা স্পষ্ট হয়েছে। আসলে উনি কী চান? বিএনপি নেত্রী ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দুই খুনী কর্নেল রশীদ ও হুদাকে এমপি বানিয়ে সংসদে বসিয়েছিলেন। জামায়াতের আলবদর-যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের ওপর আদালতের রায় কার্যকর হয়েছে, ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেত্রী তাদের মন্ত্রী বানিয়ে লাখো শহীদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। এখন উনি ওইসব খুনী-ঘাতকের সঙ্গে আলোচনার কথা বলছেন। তাই বিএনপি নেত্রীর প্রস্তাব নিয়ে এত তোলপাড় করার কী আছে? প্রধানমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক হাঙ্গেরি সফরের নানা দিক তুলে ধরতেই এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে প্রাসঙ্গিকভাবেই ঘুরেফিরে তার সফরের সময় বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটের যান্ত্রিক গোলযোগ এবং জরুরী অবতরণের বিষয়টি উঠে আসে। হাঙ্গেরি সফর ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী দেশের সবশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিএনপি নেত্রীর ইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাবসহ নানা বিষয়ে সাংবাদিকদের অসংখ্য প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দেন। সাংবাদিক সম্মেলনের সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মূল মঞ্চে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। বিপুলসংখ্যক সাংবাদিকের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিমানটির যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল ॥ প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল, বিমানে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি অন্য কোন কিছু? কবিতায় উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর জবাব, ‘জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য’। তিনি বলেন, এটা একটা যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল। দুর্ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখন বেঁচে আছি, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। সহিসালামতে দেশের মানুষের কাছে ফিরে এসেছি, দেশবাসীর দোয়া চাই। যে দেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, সপরিবারে হত্যা করা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় না, মন্ত্রী করে তাদের গাড়িতে লাখো শহীদের রক্তস্নাত পতাকা তুলে দেয়া হয়, সেখানে আর কী বলব? জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তো দেশে এসেছিলাম জনগণের কল্যাণে কাজ করব বলে। তাই যতদিন আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখবেন ততদিন মৃত্যুকে আমি ভয় করি না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আবারও সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, এটা একটা যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল, আর কিছু না। হয়ত যান্ত্রিক কিছু একটা হয়েছে। এক্সিডেন্ট তো হয়ই। ব্রাজিলে কী হলো। ফুটবল প্লেয়ারসহ প্লেন ক্র্যাশ হলো। এ্যাক্সিডেন্ট এ্যাক্সিডেন্টই। এটাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে এ্যাক্সিডেন্ট যান্ত্রিক ত্রুটিতেও হতে পারে, আবার মনুষ্যসৃষ্ট কারণেও হতে পারে, যোগ করেন তিনি। নতুন বিমান কেনার প্রস্তাব নাকচ ॥ সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য নতুন বিমান কেনার বিষয়টি সরাসরি নাকচ করে দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আলাদা বিমান কেনার মতো বিলাসিতা করার সময় আসেনি। কারণ, গরিবের ঘোড়া রোগ না হওয়াই ভাল। ঘোড়াকে খাওয়াতে, লালন-পালন করতে যথেষ্ট খরচ লাগে। আর নতুন এয়ারক্র্যাফট কেনার আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমি চাইও না। আমার দেশের জন্য নতুন উড়োজাহাজ কিনেছি। যে প্লেনে আমার দেশের সাধারণ মানুষ চলাচল করবে, সেখানে যদি আমার নিরাপদবোধ না থাকে, তাহলে আমার আলাদা প্লেন কিনে কী লাভ? আমি মানুষের সঙ্গে চলি। সাধারণ মানুষের জন্যই আমরা রাজনীতি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ’৯৬ সালের আগে বাংলাদেশ বিমান ও বিমানবন্দরের অবস্থা কী ছিল, এখন কী হয়েছে একটু তুলনা করার জন্য গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে তো কয়েকটা ঝড়ঝড়ে ডিসি-১০ বিমান ছিল। আমরা ক্ষমতায় এসে অনেক নতুন বিমান ক্রয় করেছি। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে দুটি দেশ প্রশ্ন তোলায় তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন বিমান ও বিমানবন্দরের অবস্থা ভাল। কোন শর্ত নিয়ে ভারত যাচ্ছি না ॥ সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে আসন্ন প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। সাংবাদিকদের পৃথক দুটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোন শর্ত নিয়ে ভারতে যাচ্ছি না। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশ। দেশটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যা সহযোগিতা করেছে, তা কারোরই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আমরা ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী গঙ্গার ঐতিহাসিক পানি বণ্টন চুক্তি করেছি। এখন তিস্তা চুক্তি নিয়েও আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। শুধু তিস্তাই নয়, অভিন্ন ৫৪ নদীর পানিবণ্টন নিয়েও আলোচনা চলছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ট্রেনিংসহ দ্বিপাক্ষিক নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। মিয়ানমারের কোন সন্ত্রাসী বাংলাদেশে ঠাঁই পাবে না ॥ এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, মিয়ানমারে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে এসে বাংলাদেশে কেউ ঠাঁই পাবে না। তিনি বলেন, মিয়ানমারে যা ঘটছে তা দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। মুষ্টিমেয় কিছু সন্ত্রাসীর কারণে দেশটিতে অনেক মানুষ কষ্ট ভোগ করছে। সেখানে ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে নয়জনকে হত্যা করা হয়েছে। এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে বাংলাদেশে এসে কেউ আশ্রয় পাবে না। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সেখানে তো মানুষ কষ্টে আছে। কিন্তু এই যে নয়জন মানুষকে হত্যা করা হলো, আমি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনদের বলে দিয়েছি, তাদের কেউ যদি বাংলাদেশে ঢুকে থাকে তাহলে তাদের যেন গ্রেফতার করা হয়। তাদের ধরে মিয়ানমার সরকারের হাতে তুলে দেয়া হবে। এ ব্যাপার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সতর্ক ও সোচ্চার হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। সংসদ ভবন একটি ইউনিক স্থাপত্য শিল্প ॥ প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল লুই আই কানের মূল নকশাবহির্ভূত স্থাপনাগুলো সংসদ ভবন এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা হবে কিনা? কৌশলী জবাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদে লুই আই কানের মূল নকশা এসে গেছে। এই স্থাপত্যশিল্পটি একটি ইউনিক। বিশ্ববাসী লুই কানের অমর স্থাপত্যশিল্পটি দেখতে আসেন।
×