ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চার মাসেই লক্ষ্যমাত্রার ৮১ শতাংশ অর্জন

লাফিয়ে বাড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

লাফিয়ে বাড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ এসেছে ১৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা, যা সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৮১.৩৮ শতাংশ। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পুরো সময়জুড়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকে আমানতের সুদের হার ক্রমাগত কমতে থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয়পত্র ছাড়া আর কোন লাভজনক বিকল্প পাচ্ছে না। ফলে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে সরকারের ঋণের বোঝা, বাড়ছে সুদ। এতে সরকারের রাজস্ব বাজেটের ওপর চাপ পড়ছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যমতে, গত অক্টোবরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ এসেছে ৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। আগস্ট মাসে বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার ৩২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে বিক্রি হয়েছিল ৫ হাজার ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। আর অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার হাজার ৯৩২ কোটি টাকার। এ হিসাবে প্রতিদিন এখন গড়ে ২০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ১৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা ঋণ আসে আলোচ্য চার মাসে। বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ এসেছিল ৯ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদ হার কমে আসায় মানুষ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। স্থায়ী আমানতের বিপরীতে বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে, যা সঞ্চয়পত্রের সুদের তুলনায় অনেক কম। আগে পাঁচ বছর মেয়াদী এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে মাসে এক হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পাওয়া যেত। ২০১৫ সালের মে মাসে সুদ হার কমানোর পর পাওয়া যাচ্ছে ৯১২ টাকা। তারপরও সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ এ খাতে বিনিয়োগ কমেনি; উল্টো বাড়ছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। সুদের হার কমানোর পরও বিক্রি না কমায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। অর্থবছর শেষে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ধার করেছিল। জানা গেছে, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে এ লক্ষ্য ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিক্রি বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি তার চেয়েও ৫ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা বেড়ে ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকায় পৌঁছায়। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে সরকারকে। জানা যায়, দেশে ৪ ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। এর মধ্যে ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, ৩ বছর মেয়াদী ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, ৫ বছর মেয়াদী পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ ও ৫ বছর মেয়াদী পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ২ শতাংশ কমানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক দয়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকার সঞ্চয়পত্রে ঋণের সুদ বাড়িয়েছে দরিদ্র মানুষের সঞ্চয়ের কথা বিবেচনা করে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়া মানে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়া। সুদ পরিশোধের কারণে সরকারে উন্নয়ন বাজেট কমে আসবে। সুদ হার কমানোর পরও ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হারের চেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকেই মানুষ ঝুঁকছে বলে মনে করেন তিনি। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সুদের হার কমানোর পরও গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ এবং মেয়াদ পূর্তির পর আসল শোধ করা হয়েছে ১৯ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। এ হিসাবে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকার। এ অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকবে। প্রয়োজন পড়লে সরকার এ অর্থ খরচ করবে। সরকার এ টাকা খরচ করুক বা না করুক গ্রাহকদের সুদ বা মুনাফা দিতে হবে। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমলেও ব্যাংকের আমানতে সুদহারের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। এ গবেষকের মতে, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই। জানা গেছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নেয়া হবে ২৮ হাজার কোটি টাকা, আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ ১৫ হাজার কোটি টাকা। আশার তুলনায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় গত অর্থবছরজুড়েই ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার চাহিদা ছিল কম। চলতি অর্থবছরেও একই ধারা অব্যাহত ছিল। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ৩১ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর জুন শেষে ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ কমেছে ৩ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ৭ হাজার ৮৯০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। এ সময় তফসিলী খাতের ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কোন ঋণ নেয়নি সরকার। বরং এ সময় সরকার আগের ঋণ পরিশোধ করেছে। আলোচ্য সময়ে সরকার তফসিলী ব্যাংকের ১০ হাজার ৩২০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে বিনিয়োগ মন্দা পরিস্থিতিতে সরকারের সিকিউরিটিজ এ্যান্ড ট্রেজারি বিল বা বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ করে অনেক ব্যাংক ন্যূনতম সুদহারে কিছু মুনাফা করার চেষ্টা করছে। তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার বেড়ে যাওয়ায় কমে গেছে সরকারে ঋণের চাহিদা।
×