ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

জাতিগত নিধন, সমস্যার সমাধান দেবে না

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

জাতিগত নিধন, সমস্যার সমাধান দেবে না

জাতিগতভাবে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ১০ লাখেরও বেশি মানুষের এক সময়ে বসতি ছিল মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে, যার পূর্ব নাম আরাকান। এরা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান। এখন এদের সঠিক সংখ্যা কত তা নির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও এ কথা বলা যায় অর্ধেকও নেই। যারা নেই তাদের বড় অংশ, প্রায় পাঁচ লাখের আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারের ঝোপ, জঙ্গল এবং দুর্গম পাহাড়ের খাদের মধ্যে। উন্নত ও নিরাপদ জীবনের আশায় মালয়েশিয়া অথবা অস্ট্রেলিয়ায় উত্তাল সাগর পাড়ি দেয়ার পথে অনেকের সলিল সমাধি ঘটেছে। কারও কারও গহীন জঙ্গলে খাবারের অভাবে মৃত্যু হয়েছে। শত শত বছর ধরে চৌদ্দ পুরুষের ভিটামাটি তারা সইচ্ছায় ত্যাগ করেননি। মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পিত জাতিগত নিধন বা এথনিক ক্লিঞ্জিংয়ের কবলে রোহিঙ্গারা আজ ভিটাছাড়া, উদ্বাস্তু। যারা এখনও মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, তারা প্রতিনিয়ত কেয়ামত দর্শন করছেন। জ্বালাও, পোড়াও, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন চলছে, চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা, সঙ্গে যোগ দিচ্ছে স্থানীয় উগ্রবাদী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একশ্রেণীর মানুষ। গৌতম বুদ্ধের অহিংসা পরম ধর্মের বাণী মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ধর্ম এখন অধর্মের বড় হাতিয়ার। সম্প্রতি মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর তিনটি ক্যাম্পে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের আক্রমণে ৯ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হন। তার জের ধরে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় কম্বিং অপারেশন শুরু করে। এরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর চড়াও হয়। ঘটনাস্থলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া, মানবিক সাহায্যের চালান এবং মানবাধিকার কর্মীদের মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঢুকতে দিচ্ছে না। তারপরও যতটুকু খবর বাইরে আসছে তা গণহত্যা এবং এথনিক ক্লিঞ্জিংয়ের চাইতেও ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সমান। কিন্তু মিয়ানমার সরকার যথারীতি সবকিছুকে অস্বীকার করছে। এক সময়ে তাদের ভাষ্য ছিল, রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরিক নয়, এরা সব বাংলাদেশের, অনুপ্রবেশকারী। এই ভাষ্যের কোন ভিত্তি না থাকায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়ের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ পাওয়া যাবে না, যেখানে একটি মাত্র জাতিগোষ্ঠী বা একটি ধর্মের মানুষের বসবাস। কোন যুগেই এটা ছিল না, আর এখন গ্লোবাল কনসেপ্টের যুগে সেটি আরও অসম্ভব এবং অবাস্তব বিষয়। তাই স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে- সব জেনেশুনে মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা উৎখাত, বিতাড়ন ও নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে কেন? এর সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে আলোচনার আগে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের একটু আলোকপাত দরকার। এক সময়ে বর্তমানে রাখাইন, পূর্বের আরাকান স্বাধীন রাজাদের অধীনে ছিল। তখন পূর্ববাংলার বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গে আরাকানের শাসক ও মানুষের সুসম্পর্ক ছিল। ১৭৮৪ সালে বার্মিজ (মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি) শাসক আরাকান দখল করে নেয়। সেই থেকে আরাকান বার্মার অংশ হয়ে আছে। ১৮৮৬ সালে মিয়ানমার ব্রিটিশ শাসনাধীন আসে। ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার প্রাক্কালে আরাকান প্রদেশের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়, যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, তারা আরাকানকে পাকিস্তান, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার একটা চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কেউই তখন রোহিঙ্গা নেতাদের কথায় কর্ণপাত করেননি, গুরুত্বও দেননি। তাই যথারীতি আরাকান বার্মার অংশ হিসেবেই থেকে যায়। ভৌগোলিক নিকটত্ব, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ভাষা ও সংস্কৃতির সাদৃশ্যতার কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গে আরাকানবাসীর ব্রিটিশ আমলে তো বটেই, বহু পূর্ব থেকে একটা নিবিড় সংযোগ অব্যাহত ছিল। এর আরেকটি কারণ হলো, আরাকানের পূর্ব সীমান্ত ধরে উত্তর-দক্ষিণ লম্ব আকৃতির দুর্গম পাহাড় থাকায় ওই সময়ে বার্মার মূল অংশের সঙ্গে আরাকানবাসীর তেমন সংযোগ ছিল না। এখন অবশ্য মিয়ানমার সরকার সেখানে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করেছে। বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বর্তমান নেত্রী আউং সান সুচির পিতা আউং সান বার্মাকে একটা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং আধুনিক রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় আততায়ীর গুলিতে আউং সান নিহত হওয়ায় বার্মার সবকিছু বদলে যায়। ১৯৬২ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর দৃশ্যপট আরও দ্রুত পাল্টাতে থাকে। বার্মা পরিণত হয় এক বিচ্ছিন্ন এবং দুর্ভেদ্য রাষ্ট্রে। দীর্ঘদিন থেকে অদ্যাবধি ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে থাকা সব সময়ের সেনা কর্তৃপক্ষের ধারণা হলো, আরাকানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা সম্প্রদায় মিয়ানমারের ভৌগোলিক অখ-তার জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই সেনাশাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় ছলেবলে কলেকৌশলে আরাকান, অধুনা রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের উৎখাত, দেশ থেকে বিতাড়ন ও শক্তিহীন করা গেলে বিচ্ছিন্নতাবাদের ঝুঁকি আর থাকবে না। তাই তারা ১৯৭৮ সালে প্রথমবার এবং ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার : দুই ধাপে প্রায় সাড়ে ছয় লাখের মতো রোহিঙ্গাকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পুশ ইন করে। ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে, যাতে নির্যাতন ও বৈষম্যের স্টিমরোলারের পরেও যারা থেকে যাবে তারা যেন কোন দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। একই কারণে তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বার্মিজদের সেখানে এনে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়। আরাকানের পরিবর্তে প্রদেশের নাম রাখাইন রাখার পেছনেও একই ভীতি কাজ করেছে বলে মনে হয়। মাঝখানে কিছু রোহিঙ্গা ফেরত যেতে পারলেও এখনও পাঁচ লাখের মতো বাংলাদেশে রয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গা পুশ ইনের ইস্যুটি পর পর দু’জন সামরিক শাসক ও পরে জামায়াত-বিএনপি সরকার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করায় বাংলাদেশের জামায়াতসহ উগ্র ইসলামিস্ট ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং দেশী, বিদেশী আরও অনেক উগ্র ধর্মীয় মহল এটাকে ধর্মীয় ইস্যু বানিয়ে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে কেবল নিজেদের হীনস্বার্থ উদ্ধারের কাজে। ফলে এটি এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য যেমন হুমকি সৃষ্টি করছে তেমনি মিয়ানমার সরকারও রোহিঙ্গাদের আর বিশ্বাস করতে পারছে না, ফেরতও নিতে চাইছে না। উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী যেমন এই সমস্যাকে জিইয়ে রেখে সুবিধা নিতে চাইছে তেমনি গ্লোবাল রাজনীতির খেলায় বড় খেলোয়াড়দেরও গোপন ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। হয়ত সময় সুযোগ পেলেই তারা সবাই নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করবে। দিন যত গড়াচ্ছে ততই সমস্যা সমাধানের পথ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নেত্রী আউং সান সূচির দল এ বছরের গোড়ার দিকে ক্ষমতায় এলে সকলের মনে একটা আশার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মানুষের সে আশা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে। শান্তিতে নোবেল পাওয়া নেত্রীর সরকারের অধীনে অসহায়, নিরীহ, নিরস্ত্ররা গণহত্যা, গণধর্ষণ ও লুটতরাজের শিকার হচ্ছে। এর থেকে লজ্জার আর কিছু থাকতে পারে না। তাই সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছ থেকে তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি উঠছে। বিশ্বের মানুষকে জোর দিয়ে বলতে হবে, সমস্যার সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার, সমাধানের উদ্যোগ তাদেরকেই নিতে হবে। কেবল প্রতিবেশী হওয়ার কারণে এটি এখন বাংলাদেশের জন্যও বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমার যদি আত্মঘাতী এথনিক ক্লিঞ্জিংয়ের পথ পরিহার করে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনায় বসে তাহলে এখনও সময় আছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের সব দুরভিসন্ধিকে পিছে ফেলে একটা সমাধানে পৌঁছা। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সশস্ত্র সংগঠন ও সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হবে না, বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারের এই জিরো টলারেন্সের সুযোগ এখনই মিয়ানমার সরকারের নেয়া উচিত। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশ উল্লিখিত নীতির সফল বাস্তবায়নের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে সমস্যার মূল্যায়ন ও তার সমাধানের পথ বের করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সেটাই বিশ্বাস করে। মিয়ানমারকেও এগিয়ে আসতে হবে একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। বিশ্বের সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের পক্ষে কিছুতেই অন্যদেশের ১০ লাখ মানুষকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এটা অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিমুখী আচরণ দেখে আশ্চর্য হতে হয় এবং তা কিছুটা রহস্যজনকও মনে হয়। গত তিন বছরে ভূমধ্যসাগরে কয়েক হাজার গৃহহীন উদ্বাস্তু মানুষের সলিল সমাধি ঘটার পরেও শরণার্থীদের জন্য পশ্চিমা বিশ্ব তাদের দুয়ার বন্ধ করে রেখেছে। অথচ বাংলাদেশকে বলছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য। মিয়ানমার সরকারকে আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, পাঁচ লক্ষাধিক অবৈধ, তালিকাহীন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করলে সরকারের শত আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাপ্রসূত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তাতে মিয়ানমারের অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকবে। তার জের ধরে সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়িতে সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাই মিয়ানমার সরকারকে প্রাগমেটিক হতে হবে। একটি নির্দিষ্ট জাতি গোষ্ঠীকে নিধন, উৎখাত ও বিতাড়ন করে সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত বিশ্বে কোথাও হয়নি, মিয়ানমারও তা পারবে না। লেখক : ভূ-রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নিউ অরলিনস, ইউএসএ
×