ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রায়হান আহমেদ তপাদার

অভিমত ॥ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের চুক্তি বাস্তবায়ন জরুরী

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

অভিমত ॥ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের চুক্তি বাস্তবায়ন জরুরী

মরক্কোর মারাকেশে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার যেসব দেশ বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ কমানো না গেলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করা যাবে না। আর উষ্ণতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে। বাড়বে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও। এতে সব দেশের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এতে বিশ্বে অভিবাসী সঙ্কট আরও তীব্র হবে। কাজেই জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলার বিষয়ে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই কোন দেশেরই। বিশ্বকে বসবাসের উপযোগী রাখতে হলে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের পাশাপাশি আরও যেসব পদক্ষেপ নেয়া জরুরী সেসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষেত্রে মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোর আন্তরিকতাই প্রধান। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় গত বছর প্যারিস সম্মেলনে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, চলতি বছরই তার বাস্তবায়ন শুরু“হতে যাচ্ছে। আমরা অবশ্যই এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করব। পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার প্রশ্নে শিল্পোন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে এবং তা দিন দিন বাড়ছে। এ মতভিন্নতার অবসান জরুরী। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে অনুধাবন করতে হবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য তারাই বেশি দায়ী। তদুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর যে সক্ষমতা রয়েছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তা নেই। যে কোন দুর্যোগে দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে এটি বিশ্ববাসীর জানা থাকলেও আমাদের উপকূলীয় এলাকার হতভাগ্য মানুষের দুর্ভোগের অবসান কখনও হয় না। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জলবায়ু অভিযোজন কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে ৬ হাজার ৯৭৩ কোটি ডলার ২০২০ সালের মধ্যে প্রদানের দাবি করেছে। মরক্কোর মারাকেশে কপ-২২ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য এনভায়রনমেন্টের ড. ক্যারোলিন সুলিভান প্রস্তাবিত ক্লাইমেট ভালনার‌্যাবিলিটি ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশ সবচেয়ে বিপন্ন দেশ। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘ প্রণীত ঝুঁকির তালিকামতে ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় এবং ভূমিধসের কারণে সবচেয়ে বিপন্ন দেশের তালিকায়ও সবার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাপলক্রফট একটি জরিপকারী প্রতিষ্ঠান।এই প্রতিষ্ঠানটি ১৭০টি দেশে ৪২টি মাপকাঠিতে জরিপ করে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার মধ্যেও বাংলাদেশ এক নম্বরে। অথচ বাংলাদেশে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের হার একেবারেই নগণ্য। তারপরও বাংলাদেশ এ গ্যাসের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। সমুদ্রের পানি যদি ১ মিটার বৃদ্ধি পায় তাহলে বাংলাদেশের ২১ ভাগ জমি চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে। সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল জমি ধ্বংস হবে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মৎস্যসম্পদ কমে যাচ্ছে। মৎস্যজীবী মানুষের জীবনযাত্রা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। আমরা নদী খনন, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চল সুরক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মতো নানা কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারি। উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি হ্রাসে উপকূলীয় এলাকায় আরও অধিক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, সতর্কীকরণ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এবং আবহাওয়া অফিসের কার্যক্রম আধুনিকায়নের পরিকল্পনাও এর অন্তর্ভুক্ত। মনে রাখতে হবে ধনী দেশগুলো শুধু চুক্তিই করবে, ভাল ভাল ভাষণ দেবে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করবে না। তাই এই চ্যালেঞ্জটা আমাদেরই মোকাবেলা করতে হবে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন- কনফারেন্স অব পার্টিস (কপ-২২)-এর উচ্চপর্যায়ের দুটি কর্মসূচীতে যোগদান শেষে কি আশা নিয়ে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা দেখার বিষয়। মরক্কোর মারাকেশের বাব ইগলিতে ৮০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান এবং ১১৫টি দেশের সিনিয়র মন্ত্রীরা এ সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে পানি খাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে একটি বৈশ্বিক ফান্ড গঠনের প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক হুমকি মোকাবেলায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়লাভের পর প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিয়ে সারাবিশ্ব যখন চিন্তিত, তখন আশার কথা শোনালেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। মহাসচিবের আশা, ট্রাম্প জলবায়ু চুক্তির বিষয়ে ভাল ও বিজ্ঞের মতো সিদ্ধান্ত নেবেন। বান কি মুন বলেছেন, ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করবেন, মনোযোগ দিয়ে শুনবেন আর এর গুরুত্ব অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন। বান কি মুন তার বক্তব্যে বলেন, বিশ্বের যে কোন ধনী দেশ, শক্তিশালী বা দরিদ্র যাই হোক না কেন তারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং সবাই মিলে জলবায়ু পরিবর্তনে বিপদ মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। ট্রাম্পের সঙ্গে তার প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের আলোচনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও বান কি মুন প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের আশা প্রকাশ করেন এবং এ বিষয়ে সব দেশকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে ডায়রিয়া, কলেরা, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, পানিশূন্যতা, হৃদরোগ, মানসিক রোগ, চর্মরোগ, কালাজ্বর ও পুষ্টিহীনতা বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর কারণে শিশু ও বয়স্কদের মাঝে এসব রোগের প্রকোপও বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটও বাড়ছে। এ পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহরূপ ধারণ করছে। প্যারিস সম্মেলনে এ সম্পর্কে সবাই ছিলেন নীরব। কারও কোন মাথাব্যথা ছিল না। যে যার মতো করেই কথা বলেছে। তাই কারও সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় লড়তে হবে বাংলাদেশকে। এ লড়াইয়ে আমাদের বিজয়ী হতে হবে। মারাকেশ জলবাযু সম্মেলনের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে এক পর্যালোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থপ্রাপ্তি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য একটি জটিল প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এই তহবিল থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ পাচ্ছে না। বাংলাদেশ মনে করছে, ভবিষ্যত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থায়ন বাড়াতে হলে সবুজ জলবায়ু তহবিলকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের মধ্যে তিন বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতিকে আইনী বাধ্যবাধকতায় নিয়ে আসারও আহ্বান জানানো হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিযোজন প্রকল্পে অর্থায়নে এ্যাডাপটেশন ফান্ড একটি কার্যকরী তহবিল। এই তহবিল নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি দেখা গেলেও বাংলাদেশ চাইছে এই তহবিলের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক। উন্নয়নশীল দেশগুলোরও একই অভিমত। বাংলাদেশ মনে করে, প্যারিস চুক্তির কার্যকর বাস্তবায়নই এই দুর্যোগ রুখতে পারে। এই চুক্তি অনুমোদনে সদস্য দেশগুলোর স্বতঃস্ফূর্ততায় বাংলাদেশ খুশি। এ পর্যন্ত ১৯৭টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৯১ দেশ প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং ১১০টি দেশ তা অনুমোদন করেছে। আমরা আশা করছি, খুব শীঘ্রই সকল দেশ এই চুক্তি অনুমোদন করবে। এক চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো সামগ্রিকভাবে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ১৯৯০ সালের তুলনায় শতকরা ৫ দশমিক ২ ভাগ হারে হ্রাস করবে। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচাইতে বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, সেহেতু তারা নিঃসরণ করবে ৭ দশমিক শূন্য ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন করবে ৮ ভাগ এবং জাপান করবে ৬ ভাগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু বুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই চুক্তি থেকে সরে আসেন। ফলে কিয়োটো চুক্তিটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। উন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কার্বন নিঃসরণ কমানো ছাড়াও অভিযোজন খাত নিয়ে উদীয়মান অর্থনীতির জোট বেসিক এবং জি-৭৭ চায়না কোন ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল, কাতার, জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে বিরোধ আরও বেড়েছে। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, জাপান ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিপরীত অবস্থানের কারণে খসড়া তৈরি বিলম্বিত হচ্ছে। [email protected]
×