ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অটোরিক্সা ॥ চুক্তিতে চলে ৮৬ ভাগ, বকশিশ দাবী করে ৯৭ ভাগ

প্রকাশিত: ০০:০৩, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

অটোরিক্সা ॥ চুক্তিতে চলে ৮৬ ভাগ, বকশিশ দাবী করে ৯৭ ভাগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একলাফে সিএনজি চালিত অটোরিক্সার ভাড়া ৬০ ভাগ বৃদ্ধির ১ বছর পরও এই সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। অটারিক্সায় যাত্রী হয়রানি ও ভাড়া নৈরাজ্য অব্যাহত রয়েছে। সিংহভাগ অটোরিক্সা যাত্রীর পছন্দের গন্তব্যে যায় না, মিটারে চলে না, মিটারে গেলেও অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে। যাত্রীর সঙ্গে অস্বাভাবিক দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগের মধ্যে সরকার এই সেক্টরকে শৃঙ্খলিত করতে বার বার নানা সুযোগ সুবিধা অব্যাহত রাখার পরও কেন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। গত ১ মাসব্যাপী বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নগরীর প্রায় ২ হাজার ১৬৬টি অটোরিক্সার উপর এক জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, এসব এলাকায় চলাচলকারী অটোরিক্সার ৮৬ ভাগ চুক্তিতে চলাচল করছে। যারা মিটারে চলে তাদের ৯৭ ভাগ ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত মিটারের অতিরিক্ত ভাড়া (বকশিশ) দাবী করছে। এছাড়াও যাত্রী পছন্দের গন্তব্যে যেতে রাজী হয় না ৮২ শতাংশ অটোরিক্সা। জরিপকালে যাত্রীর ইচ্ছায় চুক্তিতে চলতে দেখা গেছে ২২ শতাংশ অটোরিক্সা। সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে মতিঝিল থেকে গুলিস্তান ১০০ টাকা, সদরঘাট থেকে ধানমন্ডি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, কমলাপুর থেকে ফার্মগেট ২০০ টাকা, প্রেসক্লাব থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, প্রেসক্লাব থেকে বসুন্ধরা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, শাহবাগ থেকে কলাবাগান ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, সদরঘাট থেকে বাড্ডা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, মহাখালী থেকে যাত্রাবাড়ী ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, গুলিস্তান থেকে এয়ারপোর্ট ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, বাড্ডা থেকে ধানমন্ডি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, রামপুরা থেকে গুলিস্তান ২৫০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা, সদরঘাট থেকে গাবতলী ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা, সদরঘাট থেকে মিরপুর ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায় চুক্তিতে চলতে দেখা গেছে। অথচ এসব পথে মিটারে যাতায়াত করলে কোন কোন গন্তব্যে এসব চুক্তিকৃত ভাড়ার ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়ায় যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারতো। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত প্রায় ১৪ হাজার বাণিজ্যিক অটোরিক্সার সাথে পাল্লা দিয়ে অটোরিক্সার চাহিদা ও সংকটকে কাজে লাগিয়ে চলাচল করছে ৪ হাজার ৫০টি ঢাকা জেলার নিবন্ধিত প্রাইভেট অটোরিক্সা। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৪৬ টি প্রাইভেট অটোরিক্সা ভাড়ায় যাত্রী বহনে বাধা না দেয়ার জন্য মহামান্য হাইকোর্ট এর নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়াও গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী হতে নিবন্ধিত প্রায় ৫ হাজার অবৈধ বাণিজ্যিক অটোরিক্সা, ঢাকা জেলায় নিবন্ধিত বাণিজ্যিক নাম্বারধারী প্রায় ৬ হাজার অবৈধ অটোরিক্সা। এসব অটোরিক্সা পারমিট ও নীতিমালার শর্ত লঙ্ঘন করে প্রাইভেট ও বাণিজ্যিক অটোরিক্সা মিটারবিহীন চুক্তিতে চলাচল করছে এবং বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী বহন করছে। ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন বৈধ-অবৈধ মিলে প্রায় ২৯ হাজার অটোরিক্সা চলাচল করছে। এসব অটোরিক্সার সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৫৬ শতাংশ মিটারবিহীন চলাচল করার কারণে বৈধ বাণিজ্যিক অটোরিক্সাগুলো মিটারে চালাতে আগ্রহী নন। পর্যবেক্ষণকালে আরো জানা গেছে, কতিপয় অসাধু দুর্নীতিবাজ পুলিশ সার্জেন্ট, টিআই, পিআই, সাংবাদিক এর নামে ১৫ হাজার ৫০ টি অটোরিক্সা ঢাকা মহানগরীতে বছরের পর বছর অবৈধভাবে রাস্তায় চলাচলের কারণে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও এই সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। জানা গেছে প্রতিটি অবৈধ অটোরিক্সা নগরীতে চলাচলের জন্য প্রতিটি অটোরিক্সা থেকে প্রতিমাসে ৮ হাজার টাকা হারে মাসিক চাঁদা দিতে হয়। এতে করে এই ১৫ হাজার অবৈধ অটোরিক্সায় প্রতিমাসে প্রায় ১২ কোটি ৪ লক্ষ টাকা হিসেবে বছরে ১৪৪ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা অবৈধ লেনদেন এই সেক্টরের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান প্রতিবন্ধকতা বলে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। পর্যবেক্ষণে আরো জানা গেছে, প্রতিটি অটোরিক্সার সরকার নির্ধারিত জমা ৯০০ টাকার হলেও সিংহভাগ মালিক এক হাতে বা এক চালক দিয়ে দৈনিক ১হাজার ৫০ টাকা এবং ২ শিফটে বা ২ জন চালক দিয়ে দুই বেলায় দৈনিক ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ১হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত জমা আদায় করছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ ভাবে অটোরিক্সা চালকদের কাছ থেকে অবৈধভাবে টোল আদায় করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষণকালে আরো দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে চলাচলকারী অটোরিক্সা চালকের প্রায়ই ৬২ ভাগের বৈধ লাইসেন্স থাকলেও ২২ ভাগ চালক ভূয়া লাইসেন্স দিয়ে অটোরিক্সা চালিয়ে থাকে। তবে ১৬ ভাগ চালকের হাতে বৈধ বা অবৈধ কোন লাইসেন্স নেই। তারা বছরের পর বছর সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে অটোরিক্সা চালায় বলে পর্যবেক্ষকদের কাছে জানিয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা ও মনিটরিং টিমের সদস্যদের গবেষনায় উঠে এসেছে যে সরকার যাত্রী সেবার মান উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষায় ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগরী থেকে টু স্টোক বেবি ট্যাক্সি উচ্ছেদ করে ১২ হাজার ৩০০ টি সিএনজি চালিত অটোরিক্সা গণপরিবহণের বহরে সংযুক্ত করে। গত ১৩ বছরে ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা প্রায় ৩ গুন হয়েছে, পাশাপাশি সামর্থ্যবান যাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু এখনও ১৩ বছর পূর্বের নির্ধারিত অটোরিক্সার সিলিং বর্তমানেও বহাল থাকায় অটোরিক্সার চাহিদা ও সংকটকে কাজে লাগিয়ে এই সেক্টরে মালিক-শ্রমিকরা যাচ্ছে তাই নৈরাজ্য চালাচ্ছে। সমিতির সুপারিশমালা ॥ ঢাকা মহানগরীর অটোরিক্সা সংকট নিরসনকল্পে সিএনজি অটোরিক্সার সিলিং প্রথা বাতিল করা, অটোরিক্সার সার্ভিস নীতিমালা-২০০৭ বাস্তবায়ন করা, প্রতিটি অটোরিক্সায় যাত্রীর আসনের সামনে ভাড়ার তালিকাসহ মালিক, চালক, বিআরটিএ’র অভিযোগ কেন্দ্র, পুলিশের ট্রাফিক অভিযোগ কেন্দ্রের নাম ও ফোননম্বরসহ একটি নোটিশ ঝুলানোর ব্যবস্থা করা, ঢাকা মহানগরীর বাইরের জেলায় নিবন্ধিত ও প্রাইভেট অটোরিক্সা সমূহ নগরীতে চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া, সিএনজি অটোরিক্সার ভাড়া, জমা ও ইকোনোমিক লাইফ বৃদ্ধির পূর্বে গণশুনানীর উদ্যোগ নেওয়া এবং যাত্রীস্বার্থ সুরক্ষায় মালিক-শ্রমিকদের পাশাপাশি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধি রাখা, সিএনজি অটোরিক্সার পুনঃনির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করণ সংক্রান্ত বিআরটিএ গঠিত মনিটরিং কমিটিতে যাত্রী অভিযোগ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে মালিক-শ্রমিকদের পাশাপাশি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা, অটোরিক্সার নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার পাশাপাশি ট্রাফিক ইন্সপেক্টরদের নেতৃত্বে মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা, মিটার টেম্পারিং বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে মিটার চেকিং এর উদ্যোগ নেয়া। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। এতে বক্তব্য রাখেন- সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবির হিরু, বুয়েটের দূর্ঘটনা গবেষনা ইনিষ্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান চৌধুরী, নাগরিক সংহতির সভাপতি শরিফুজ্জামান শরিফ, ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি মো. বরকত উল্লাহ ভুলু, ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন প্রমুখ।
×