ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মাল্টা আবাদের ঢেউ বরেন্দ্রে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

মাল্টা আবাদের ঢেউ বরেন্দ্রে

ফলের নাম মাল্টা। মূলত এই ফলটি ফলে ভারতের উষ্ণ এলাকায়। সেই মাল্টা এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও নওগাঁর বরেন্দ্র ভূমির অন্যতম প্রধান ফলের সারিতে উঠে আসছে। এই অঞ্চলের আম, টমোটো, পেয়ারার পরপরই স্থান করে নিয়েছে মাল্টা। সাড়া জাগানো এই ফলের আবাদ করার বিষয়ে এই অঞ্চলের কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বরেন্দ্র ভূমির লাল মাটিতে প্রধান আবাদের তালিকায় এখনও ধান। গত কয়েক বছরে উৎপাদন বাম্পার হয়েছে। কিন্তু দাম না থাকায় এবং শ্রমিকের অভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তারা বরেন্দ্রতে বিকল্প ফসল বা লাভজনক কৃষি পণ্যের উৎপাদন চায়। নাচোল, গোদাগাড়ী, তানোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরসহ ২১ উপজেলা হলেও বরেন্দ্র ভূমির বিস্তৃতি রাজশাহী ও নওগাঁ জেলা পেরিয়ে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ ছাড়িয়ে গেছে। এসব অঞ্চলের জলবায়ূ অনেকটা একই ধরনের। বিশ্লেষণে দেখা যায় বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো এই অঞ্চল ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ুর অন্তর্গত। এখানে ষড়ঋতুর মধ্যে প্রধানত তিনটি মৌসুম জোরালো। বর্ষা মৌসুম সাধারণত মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। শতকরা ৯২ ভাগ বা তারও বেশি বর্ষণ এ সময় হয়। শীতকাল শুরু নবেম্বরে এবং শেষ হয় ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগে। এ মৌসুম অত্যন্ত শুষ্ক ও শীতল, কখনও কখনও সামান্য বৃষ্টিপাত হয়। মার্চ ও এপ্রিলকে গ্রীষ্ম বা প্রাক বর্ষাকাল বলে গণ্য হয়। এ সময় বাতাস খুবই উত্তপ্ত এবং বাতাসে জলীয় বাষ্প খুবই কম থাকে। মাঝে মাঝে বর্ষণসহ ঝড় বা দমকা বাতাস বয়। যাকে কালবৈশাখী বলা হয়। এ সময় শিলাবৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়। তাপমাত্রার উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে পরিলক্ষিত হয় ৮.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। চরম উষ্ণ তাপমাত্রা মে মাসে (৪৫.০ ডিগ্রী সেলসিয়াস), ফেব্রুয়ারিতে ৯.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আবহাওয়া দফতরের সরবরাহকৃত ১৯৬৪ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ৩৭ বছরের মৌসুমের বিবরণ থেকে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনে গত কয়েক বছরে বা এক যুগের বেশি সময় ধরে শুষ্কতা ও বৃষ্টিপাতের খাম খেয়ালীতে অসহনীয় পর্যায় থাকলেও লাভ লোকসান দুটোই লক্ষণীয়। জলবায়ুর এই প্রভাবে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, শিশিরপাত, শিলাবৃষ্টি, কুয়াশা ও আর্দ্রতাতে অসমতা লক্ষ্য করা গেলেও প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো উদ্ভিদ ও ফসলের ধরণে ভিন্নতা দেখা যায় বহিরাগত উদ্ভিদের চারা রোপণের কারণে প্রকৃতিগতভাবে কোন সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। যেমন মাল্টা চাষ। এখানে মাল্টার আবাদ বীজ বুনে না হওয়ার কারণে চারা রোপণের মাধ্যমে চাষাবাদ শুরু করায় কোন সমস্যা চাষীদের বিব্রত করতে পারেনি। যেমন পেয়ারা ও টমেটোর আবাদ কৃষককে সমস্যায় ফেলেনি। শুধুমাত্র টমেটো চাষে বীজতলা তৈরি করতে হয় বলে কিছুটা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। তবে কয়েক বছরের টমেটো আবাদে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব বরেন্দ্র অঞ্চলে তেমন দেখা যায়নি। পাশাপাশি মাল্টা আবাদের চাষীরা এখন পর্যন্ত কোন সমস্যার পড়েনি। উপরন্তু বরেন্দ্রর চাষীরা মাল্টা আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে মাল্টা আবাদে প্রথম সূচনা করেন এক উদ্যোমী যুবক। তার নাম মতিউর রহমান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়ক বিভাগে ড্রাইভারের চাকরি করেন। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন নার্সারি ঘুরে বেড়াতেন। দেশের সর্ববৃহৎ হর্টিকালচার সেন্টার। যা চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুরে অবস্থিত। সেখান থেকেই প্রেরণা মাল্টা চাষের। সরকারী এই কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ড. সাইফুর দ্বিতীয় শষ্য বহুমুখী প্রকল্পের আওতায় প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। মতিউর এই প্রদর্শনী ঘুরে দেখার সময় প্রকল্পের পরিচালক হামিদুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার প্রেরণায় ২০১২ সালের দিকে মাল্টার চারা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন বরেন্দ্র অঞ্চলে। কঠোর পরিশ্রমে বাগান গড়ে উঠলেও উৎপাদিত মাল্টায় মিষ্টির পরিমাণ কম হওয়ায় তিনি বাগানের সমস্ত গাছ তুলে ফেলে গেলেন ড. সাইফুরের কাছে। তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। নতুন চারা গাছ সরবরাহ করায় ফের বাগান করার উদ্যোগ নেন মতিউর রহমান। এ দফায় আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়টা ২০১৩ সালের দিকে। হামিদুর রহমান এখন কৃষি সম্প্রসারণের মহাপরিচালক। তিনি দুইবার মতিউরের মাল্টা বাগান পরিদর্শন করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নয়াগোলা হয়ে আমনুরা জংশনমুখী সড়কের ধারে, গড়ে ওঠা নতুন শিল্প নগরী শহরের কাছাকাছি পাঁচ একর ৩৩ শতক জমির ওপর মতিউরের মাল্টা বাগান। এলাকাটি খুবই নির্জন ও মনোমুগ্ধকর। দুই বছরের মধ্যে মতিউরের বাগানে মাল্টার ঢল নামে। দুইশ’ গাছ রয়েছে তাঁর বাগানে। কোনটারই উচ্চতা ১০ ফুট ছাড়িয়ে যায়নি। সর্বোচ্চ মাল্টার পরিমাণ ২১৪টি। এক কথায় ডালপালা ভেঙ্গে মাল্টা আসে প্রথম বছর। খেতেও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে মিষ্টি। দেখতেও অনেক বড়। তিনটাতে এক কেজি পেরিয়ে যায়। রঙে রসে মনকাড়া হওয়ার কারণে বাজারে মতিউরের মাল্টা এলে খদ্দেরদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। এই মাল্টায় যেমন পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে তেমনি রয়েছে কার্বোহাইড্রেড, মিনারেল ও ক্যালরি। অত্যন্ত পুষ্টিকর মাল্টা ক্যান্সার ও ডায়াবেটিক প্রতিরোধে কাজ করে। মতিউর জানান, সেপ্টেম্বর থেকে হারভেস্ট শুরু হয়ে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে। যার কারণে গাছে এখন মাল্টার পরিমাণ কম। তবে এখনও ঝুলছে থোকা থোকা মাল্টা। এরমধ্যে আবার নতুন করে ফুল এসেছে। মতিউর জানান, বছরে তিনবার মাল্টার উৎপাদন হয়ে থাকে। যদিও পরিপূর্ণতা পেতে সময় নেয় ৪/৫ মাস। তবু তার আগেও খাওয়া ও বাজারজাত করা যায়। তিনি বাগান সম্প্রসারণে আরও এক হাজার চারা লাগিয়েছেন। মাল্টা চাষের পাশাপাশি এ আবাদের সম্প্রসারণে চারাও তৈরি করেছেন। এক লাখ ২৮ হাজার চারার মধ্যে ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়েছে ১৫ হাজার। যার মূল্য পেয়েছেন ২৮ লাখের কাছাকাছি। সব মিলিয়ে সফল মাল্টা চাষী মতিউরের দাবি সরকারী সহযোগিতার মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলে আরও ২৫ থেকে ৩০ একর জমি পেলে এগিয়ে যেতে পারেন। বর্তমানে তার নার্সারি থেকে বহিরাগতরা যেসব বাগান করেছে বা মাল্টা বাগান করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তাতে দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষের মাল্টার চাহিদা পূরণ হবে। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাল্টা আবাদের যে ঢেউ লেগেছে তাতে আগামী দেড় যুগের মধ্যে দেশের পুরো চাহিদা পূরণ হবে। বিদেশ থেকে মাল্টা আমদানি করতে হবে না। -ডি. এম তালেবুন নবী চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে
×