ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশে বিদেশী ফল

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

দেশে বিদেশী ফল

দেশে এখন হচ্ছে হরেক রকম বিদেশী ফলের চাষ। একটা সময় বিদেশ ফেরতরা সে দেশের ফলের কতই না গল্প করেছে। যা শুনে সাধারণের কল্পনা বেড়ে গেছে। মনে হয়েছে বিদেশী ফল কতই না স্বাদের। একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে যখন দুই একটি করে বিদেশী ফল আমদানির হাত ধরে অতিথি হয়ে এলো, তখন কদর গেল বেড়ে। আমাদের দেশের ফল যে কত মিষ্টি ও কত স্বাদের তা ভাবার অবকাশ ছিল না। এরই মধ্যে ফল বিশেষজ্ঞগণ মাঠে নামলেন, কীভাবে বিদেশের ওইসব ফল দেশে ফলানো যায়। বিদেশী ফলের নাম বেশ আকর্ষণীয়। স্ট্রবেরি, ড্রাগন, মাল্টাসহ কত কী। কোন ফলের ইংরেজী নাম উচ্চারিত হলেই মনে করা হয় এটাই বুঝি বিদেশী ফল। আসলে আমাদের দেশের অনেক ফল বিদেশী নামে পরিচিতি পেয়েছে। যেমন গ্রীষ্মকালীন ফল লিচু। এ নামই যথেষ্ট। হুট করে বড় লিচুর নাম হয়ে গেল বোম্বাই লিচু। দেশেই ফলছে নানা জাতের আম। বলা নেই কওয়া নেই এক জাতের আমের নাম দেয়া হলো মাদ্রাজ সুন্দরী। এখন আর শীত গ্রীষ্ম নেই। নতুন জাতের কোন ফল এলেই একটা নামকরণ করা হয়। ইংরেজী নাম হলে চলল কিছুদিন সেই নাম। তার পর... তার আর পর নেইয়ের মতো। তবে এর মধ্যে কয়েকটি বিদেশী ফল বেশ বড় আসন করে নিয়েছে। তার একটি স্ট্রবেরি। আদি নিবাস থাইল্যান্ড। কেউ বলে স্ট্রবেরি নামের এই ফলটি পাশ্চাত্যের। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফলে। সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার এই ফলের উৎপাদন ভাল। বছর কয়েক আগে বগুড়া রাজশাহী নাটোর পঞ্চগড় অঞ্চলে স্ট্রবেরি চাষের ধুম পড়ে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের জৈব প্রযুক্তিবিদ ড. এম মঞ্জুর হোসেন স্ট্রবেরি ফল উৎপাদন নিয়ে গবেষণা করে সফল হন। গবেষণা দল টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে সোমাক্লোনাল ভেরিয়েশন প্রযুক্তির সাফল্যে স্ট্রবেরির তিনটি জাত উদ্ভাবন করেন। এই দেশের আবহাওয়ায় স্ট্রবেরি চাষ উদ্ভাবনের পর এর চারা বিতরণ শুরু করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানের কৌতূহলী ফল চাষী চারা কিনে নিজেদের জমিতে চাষ শুরু করে। তেমনই স্ট্রবেরি চাষী বগুড়ার দুই তরুণ মুজাহিদুল ইসলাম রানা ও হুমায়ূন কবির। ফুলবাড়িতে নিজেদের বাড়ি সংলগ্ন আট শতাংশ ভূমি চারদিক ঘিরে গোবর সার দিয়ে উর্বরা বাড়িয়ে দশ ফুট দৈর্ঘ্যরে একেকটি বেডে চারা রোপণ করলেন। প্রতিটি বেডেই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা করেন। এই ফল চাষে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালভাবে রাখতে হয়। দিনে ২০ থেকে ২৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস ও রাতে ১২ থেকে ১৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে। স্ট্রবেরির জন্য প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা সূর্যালোক দরকার। যে কারণে শীত মৌসুমের শুরুতে অক্টোবরের শেষ দিকে চারা রোপণ করলে ভাল ফলন মেলে। রোপণের চার মাসের মধ্যে ফল ধরতে শুরু করে। প্রতি সপ্তাহে ২৬ থেকে ২৮ কেজি ফল মেলে। তবে ফল তুলতে হয় এক দিন পর পর। প্রতি কেজি স্ট্রবেরি বিক্রি হয় আটশ’ টাকা দরে। এই ফল পাইকারি ফলের দোকানের চেয়ে শপিং মলে বেশি বিক্রি হয়। বিদেশী ফল হলেই যে তা খুব ভাল হবে এবং স্ট্রবেরির চাহিদা বেড়ে যাবে, এই ধারণা পাল্টাতে সময় নেয়নি। বছর দুয়েক ফল বেচাকেনার পর যারা চাষ করেছিল তারা আর চাষ করেনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায় বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে স্ট্রবেরির চাষ হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। বাণিজ্যিক উৎপাদন হয়ে প্রতিটি স্থানে সরবরাহ হয়েছে, এমনটি জানা যায়নি। আরেকটি ফল কমলা। শীতের এই ফল আধা বিদেশী। দেশের নির্দিষ্ট এলাকায় এই কমলা ফলে। একটা সময় শুধু সিলেটেই কমলা ফলেছে। বর্তমানে চট্টগ্রামে ও পঞ্চগড়ে বিচ্ছিন্নভাবে কমলা ফলছে। শীত মৌসুমে ভারতীয় কমলার পাশাপশি দেশের কমলা বিক্রি হয়। এই কমলা আবাদে অনেকটা সফল হয়েছিলেন বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার খালসাকান্দি উত্তরপাড়া গ্রামের রেজোয়ান। সিলেট ও পঞ্চগড় থেকে কমলার চারা এনে বিশেষ ব্যবস্থায় রোপণ করে প্রথমে ভাল ফল পাননি। কমলা না হয়ে বড় লেবু হয়েছিল। তিনি লেগে থাকেন। অনুমান করতে পেরেছিলেন বগুড়ার মাটিতে ভাল বাতাবি লেবু ফলে। তিনি বাতাবি লেবুর সঙ্গে কমলার চারার কম্বিনেশনে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। তখনও সফলতা আসেনি। এরপর দুই গাছের ডাল একত্রে কলম করে এক ধরনের মিক্সড গাছে রূপান্তর করেন। কিছু দিনের মধ্যে ৬ ফুট উচ্চতায় গাছ বেড়ে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটতে থাকে। এরই মধ্যে পাতার ধরণ পাল্টে যায়। মনে হবে এ যেন মিশ্র এক ধরণের পাতা। কিছু দিনের মধ্যে লেবুর আকৃতি বেড়ে যায়। কমলার খোসার মতোই ফলের ওপর আবরণ পড়তে থাকে। একটা সময় আধা কমলা আধা সবুজ রঙের খোসা ছাড়িয়ে কোয়া খেয়ে কমলার মতো মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়। তার ২৫টি গাছের প্রতিটিতে গড়ে দু’শ’ করে কমলা ধরে। এরপর তিনি নিজে কমলার নার্সারি করে চারা বিতরণ করেন। তার এই সাফল্য তিনি ধরে রাখতে পারেননি। বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে একই পদ্ধতিতে স্বল্প পরিসরে কমলার চাষ করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশী ফলের চাষ কৌতূহলী হয়ে শুরু করা হয়। তবে তা ধরে রাখা যায়নি। এরমধ্যে কমলার বিকল্প হিসেবে মাল্টা ও ড্রাগন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এইসব ফলের প্রতি আগ্রহ কতদিন ধরে রাখা যাবে, এমন প্রশ্ন উঠে আসে পূর্বের ফলাফল দেখে। এক ফল চাষী আশাবাদী হয়ে বললেন, বিদেশী ফল যে এই দেশেও উৎপাদন সম্ভব তা যখন প্রমাণিত হয়েছে তখন সরকারের কৃষি বিভাগের উচিত বিদেশী ফল চাষে উৎসাহ দেয়া। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×