ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশের ছত্রছায়ায় রাজধানীর ফুটপাথে চাঁদাবাজি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

পুলিশের ছত্রছায়ায় রাজধানীর ফুটপাথে চাঁদাবাজি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে শুধু হকাররাই নয়, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও বড় বাধা, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র এমনটাই দাবি করেছেন। দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ফুটপাথ থেকে হকার এবং তাদের অস্থায়ী দোকান উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। তবে এজন্য শুধু হকারদের দায়ী করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা হকারদের সাহায্য করে। তাদের সহায়তার কারণে ফুটপাথ ও রাস্তা থেকে হকারদের উচ্ছেদ করার পরও, তারা আবারও তা দখল করে নেয়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দল, সিটি কর্পোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নেন। এ কারণেই উচ্ছেদের কয়েক ঘণ্টা পর হকাররা আবার ফুটপাথ ও রাস্তা দখল করে তাদের ব্যবসা শুরু করে।’ ২০১৫ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে ফুটপাথ দখলমুক্ত করা। এ নিয়ে উত্তরের মেয়র আনিসুল হক, দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৈঠক করেন। এ সময় তারা ফুটপাথ হকারমুক্ত করার ঘোষণা দেন। তবে একথা বলা যতটা সহজ ছিল করাটা ততটাই সহজ নয়। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই নিয়মিতভাবে ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এ কাজ করতে গিয়ে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগসহ ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের বাধার সম্মুখীনও হতে হচ্ছে। সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর গুলিস্তানে উচ্ছদ অভিযান চালানো হয়। ওই সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন হকার ও স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতারা। এ সংঘর্ষে পল্টন থানা ওসিসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে দক্ষিণের মেয়র উচ্ছেদ হওয়া হকারদের মহানগর নাট্যমঞ্চের কাছে সাময়িকভাবে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। তবে পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের হয়রানি থেকে বাঁচতে হকাররা তাদের সংগঠনের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। হয়রানির প্রতিবাদে ২৭ নবেম্বর বাংলাদেশ হকার্স ও ফেডারেশন এ্যান্ড বাংলাদেশ হকার্স লীগ রাজধানীতে বিক্ষোভ করেছে। এ দুই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট এমএ কাশেম বলেছেন, ‘আমাদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা না করার আগে তা উচ্ছেদ করা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।’ উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্থানীয় নেতা এবং পুলিশের মদদপুষ্ট চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফুটপাথ দখলমুক্ত করা সম্ভব হবে না। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে এসব দখলকারী মানুষের হাঁটার পথ দখল করে এবং কিছু কিছু জায়গায় স্থায়ী দোকানও তৈরি করেছে।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, চাঁদাবাজ বা লাইনম্যানরা গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ, ফার্মগেট, নিউ মার্কেট, গুলশান, মিরপুর ১ ও ১০ নম্বর, মহাখালী ও উত্তরা এলাকায় বসা হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত টোল আদায় করেন। গুলিস্তান এলাকায় ফুটপাথে তৈরি পোশাক বিক্রি করেন সাইফুল। তিনি বলেন, ‘১০ বছর আগে যখন ফুটপাথে হকারি শুরু করি তখন স্থানীয় এক নেতাকে দুই লাখ টাকা দিতে হয়েছিল। আর এখন লাইনম্যানকে দৈনিক ২০০ টাকা টোল দিতে হয়।’ সাইফুল আরও বলেন, ‘ফুটপাথে ব্যবসা করতে হলে প্রত্যেক হকারকেই ২-৫ লাখ পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। এরপর দৈনিক ১০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। টোল না দিলে ফুটপাথে ব্যবসাও করা যায় না।’ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এক সূত্র জানিয়েছে, গুলিস্তান এবং আশপাশের এলাকায় পাঁচ হাজার হকার রয়েছেন। এসব দোকান থেকে দৈনিক গড়ে ৩০০ টাকা নিলেও লাইনম্যান প্রতিদিন ১৫ লাখ টাকা তোলেন। একটি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের মদদপুষ্ট বাবুল ও সর্দার আমিনের নেতৃত্বে গুলিস্তান এলাকায় ২০ লাইনম্যান রয়েছেন। ফার্মগেট এলাকার আইবিএ হোস্টেল থেকে টি এ্যান্ড টি এলাকা পর্যন্ত টোল তোলার দায়িত্বে আছেন শাহ আলম নামে এক লাইনম্যান। তিনি যুবলীগ ও ফার্মগেট হকার্স ওয়েলফেয়ার সংস্থার সেক্রেটারি। তেজগাঁও কলেজের কাছে হকারি করেন জলিল। তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে শাহ আলম ও তার লোকজন প্রতিদিন হকারদের কাছ থেকে টোল আদায় করেন। ফার্মাগেটের প্রত্যেক হকারের কাছ থেকে তারা দৈনিক দেড় হাজার থেকে দুই হাজার করে টাকা তোলেন।’ এ বিষয়ে জানতে শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ফার্মগেট এলাকায় কানা দুলাল নামে আরেকজন টোল আদায় করেন। এছাড়া, বায়তুল মোকাররম এলাকায় কটন ও সাজু, জুরাইনে সিরাজ তালুকদার, সেলিম ও মওদুদী নূর ইসলাম, যাত্রাবাড়িতে তোরাব আলী, নিউ মার্কেট এলাকায় হোসেন, সাত্তার ও রফিক টোল তোলেন। ফার্মগেট এলাকার এক হকার বলেন, ‘লাইনম্যানরা কোন দলের সেটা আসলে কোন বিষয় নয়। কারণ, যখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকবে তখন ওই দলের নেতারাও টোল তুলবেন।’ শাহবাগ এলাকায় খাবার বিক্রি করেন এমন একজন জানান, প্রতিদিন রাতে পার্শ্ববর্তী থানার একজন সাবইন্সপেক্টর বন্ধুদের নিয়ে তার স্টলে আসেন। বেশ কিছু সময় আড্ডা দেন এবং খান। আর যাওয়ার সময় ১০০-২০০ টাকা নিয়ে যান। এ বিষয়ে উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থেকে হকাররা তাদের ব্যবসা চালান।’ এ কাজে পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘সব পুলিশ নির্দোষ নয়। তবে বিষয়টি উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের নজরদারিতে রয়েছে। এ কাজে কোন পুলিশ কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
×