ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিশ্বস্বীকৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিশ্বস্বীকৃতি

বাঙালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এ আনন্দ সংবাদ প্রতিটি বাঙালীর মনে অভাবিত গৌরব এনে দেবে। ইউনেস্কো তার ওয়েবসাইটে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের হয়। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোতে তরুণরা এটা শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালীর নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণীর প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরও যে কয়েকটি কারণ ইউনেস্কো উল্লেখ করেছে তা হচ্ছে, এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালীর ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়। ইউনেস্কোর প্রথম স্বীকৃতিলাভ করে বাংলাদেশের বাউল সঙ্গীত। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি বুনন শিল্প লাভ করে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। মঙ্গল শোভাযাত্রার ইউনেস্কোর স্বীকৃতিলাভের জন্য যারা কাজ করেছেন তাদের সাধুবাদ প্রাপ্য। বাংলাদেশে বিভিন্ন পালাপার্বণে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে নববর্ষে ঢাকার চারুকলার শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্ণাঢ্য ও ব্যতিক্রমী। এতে সর্বস্তরের উৎসবকামী মানুষ যোগ দেয়। ১৯৮৯ সালেই প্রথম অত্যন্ত অর্থবহ প্রতীকী ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ হয়ে এই শোভাযাত্রাটির সূচনা ঘটে। শোভাযাত্রার প্রতীক বা মোটিভসমূহ বেছে নেয়া হয়েছিল দেশের পল্লী অঞ্চলের শিশুর প্রথাগত খেলনা থেকে, যা আমাদের লোক ঐতিহ্যেরই ধারক। সেসব হলো হাতি, ঘোড়া, পাখি ও মুখোশ। গ্রামবাংলার বৈশাখী মেলায় একদা এসব ছিল সহজলভ্য। এখনকার শহুরে বৈশাখী মেলায় এসবের কিছু কিছু পাওয়া যায়। শোভাযাত্রার জন্য যখন এসব মোটিফ পুনঃনির্মাণ করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই নির্মাণ উপাদান, আকার, আয়তন ও ব্যবহার বিধির পরিবর্তন ঘটানো হয়। স্বৈরাচার সাম্প্রদায়িক দানবের প্রতিপক্ষ হিসেবে সেই মঙ্গল শোভাযাত্রা গোটা দেশের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়। সেই থেকে প্রতিবছরই আয়োজিত হয়ে আসছে চারুকলার এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে যোগ হয়ে চলেছে নতুন নতুন প্রতীক ও ব্যঞ্জনা। ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সব বাঙালীর উৎসব হলো পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ বরণ উৎসব। বাঙালীর একমাত্র অসাম্প্রদায়িক এই উৎসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যে আরও উজ্জ্বল হলো, এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই। বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতি গভীর ব্যঞ্জনাম-িত তাৎপর্যময় উপাদানের আকর। ভুলে গেলে চলবে না এই ঐতিহ্যের বিরোধিতাকারীও সমাজে একেবারে নগণ্যসংখ্যক নয়। রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবে বোমা হামলাই তার প্রমাণ। এখনও নববর্ষে কিছু কুলাঙ্গার উৎসবের মুক্তধারাকে ম্লান এবং এতে নারীর অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের অবশ্যই রুখতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশ্বস্বীকৃতি আমাদের সামনে সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে এসেছে দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার। আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসমথিত একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিলাভের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশ্ব প্রসারের যথাযথ উদ্যোগ গৃহীত হয়নি, এটা দুঃখজনক। এখন আমাদের ভাবতে হবে কিভাবে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে আরও মহিমাযুক্ত করে তোলা যায়। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরী হয়ে উঠেছে।
×