ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

চতুর্থ অধ্যায় মহামান্য ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব উদ্্যাপন (গতকালের পর) আবদুল বারী মালিক (সম্ভবত) রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের যে কমিটি ছিল তার উপদেষ্টা ছিলেন। কমিটির সভাপতি ছিলেন আমারই শিক্ষক অধ্যাপক সারওয়ার মুর্শেদ খান। মালিক সাহেব আমাকে একদিন ডাকলেন এবং বললেন যে তোমার মুখ্যসচিব একজন সংস্কৃতিসেবী। তার সঙ্গে আমার একটি মোলাকাতের ব্যবস্থা কর। আমার মনে হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান নিয়ে যেসব ঝামেলা হচ্ছে তার সমাধান সহজেই তার কাছে পাওয়া যাবে। আমি তার কথামত যথাযথ ব্যবস্থা নিলাম। হাশেম রেজা সাহেব তার সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন এবং আমি যখন তার এবং তার পরিবারের কাহিনীটি বললাম তখন তিনি খুবই অভিভূত হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তার মোলাকাতের একটি সময় দিয়ে দিলেন। মালিক আবদুল বারী সম্ভবত ২/১ জন সঙ্গী নিয়ে মুখ্যসচিবের সঙ্গে তার বাড়িতে দেখা করেন এবং আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে মূল বক্তব্যটি মালিক সাহেব অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি হাশেম রেজাকে বললেন, আপনি একজন সুরুচিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে জানেন যে অনেক বিখ্যাত মানুষের নামেই অনেক ভাষা এবং সংস্কৃতি পরিচিত হয়। ইংরেজী ভাষার বিষয়ই যদি ধরেন তাহলে সহজেই বলবেন, শেক্সপীয়র ছাড়া ইংরেজী ভাষাটি আবার কী। আমাদের বাংলা ভাষার ব্যাপারেও সেই রকম ধারণা পরিচিত যে, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা ভাষা আবার কি। আপনি হয়তো জানেন যে, রবীন্দ্রনাথ হলেন প্রাচ্যের প্রথম নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং তিনি সেটা পান নোবেল পুরস্কার প্রতিষ্ঠার ত্রয়োদশ বছরে অর্থাৎ ১৯১৩ সালে। সেই রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী এদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় আনন্দঘন উৎসব। এই উৎসব পালনে কোন প্রতিবন্ধকতা দেশের জন্য খুব ভাল হবে না। তখন হাশেম রেজা সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন যে, তার এই বক্তব্যের উদ্দেশ্যটা কি। সেই প্রশ্নের উত্তর আমিই দিলাম। আমি বললাম ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট হলো ঢাকার সর্বোত্তম হল ঘর। সকলেই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সভা-সমিতি, গান-বাজনার আসর বা নাটক অভিনয়ের জন্য ব্যবহার করেন। সেই হলটির মালিক ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট। সরকারি একটি অলিখিত হুকুমে এই হল ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেবার অধিকারী পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি। আমি এই সম্পাদকের দায়িত্ব সরকারি হুকুমে প্রাপ্ত হই, নিজে নির্বাচন করে বা তদ্বির করে পাইনি। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান কমিটি যখন এই হলটির জন্য দরখাস্ত করেন তখন আমি অনুমতিপত্রটি তাদের প্রদান করি। কিন্তু তার কিছুদিন পরে ব্যুরো অব রিকন্ট্রাকশনের নির্দেশ অনুযায়ী আমি এই অনুমতিপত্রটি বাতিল করি। জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান কমিটির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বারী সাহেব হলটি ব্যবহারের অনুমতি চাচ্ছেন।’ হাশেম রেজা সাহেব তখন বারী সাহেবকে বললেন, ‘এই যদি আপনার সমস্যা হয় তাহলে সেটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। তবে আমার কাছে বলা হয়েছে যে এই অনুষ্ঠানে ভারতীয় সহায়তা ও ইন্ধন রয়েছে।’ বারী সাহেব তাকে অতিরিক্ত বক্তব্য প্রদানে বিরত করে বললেন, ‘এই অনুষ্ঠানের জন্য কোন ধরনের চাঁদা আদায় করা হবে না। আমি নিজেই তার ব্যবস্থা করবো এবং যে কোন সময়ে এই হিসাবটি আপনাকে দিতে পারবো।’ সেখানেই মোলাকাতটি শেষ হলো। বিচারপতি সৈয়দ মুরশেদ ছিলেন রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উৎসব কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনিই এই অনুষ্ঠানের জন্য খরচ নির্বাহের দায়িত্ব নেন এবং এজন্য কোন চাঁদা আদায়ের ব্যবস্থা রাখেন নি। জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান কমিটি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে অনুষ্ঠান পালনের অনুমতি পেলেন এবং কিভাবে সেই অর্থ সংকুলান হয় সেটা খুব সম্ভব মালিক আবদুল বারী এবং বিচারপতি মুরশেদ সাহেবরাই জানেন। মুখ্যসচিব এজন্য কোন হিসাব নেয়ার জন্য অথবা সেটা তার কাছে উপস্থাপনের জন্য কোন নির্দেশ কাউকেই দেন নি; আমাকে তো নয়ই। হাশেম রেজা সাহেবের সঙ্গে আমার আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয় যখন তিনি এক মাসের জন্য সাময়িক লাট বাহাদুর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে আমরা বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তিনি তখন কোন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। তার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয় ১৯৯৮ সালে করাচিতে একটি চিন্তা কোষের সেমিনারে। উদার এবং পরিশীলিত মন ও আচরণের তিনি এবং তার স্ত্রী ছিলেন প্রতিভূ বিশেষ। তার দুই কন্যা এবং একটি অল্প বয়স্ক ছেলে আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলো। আমার সিলেটে এই বছর দুটি নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে একটি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ব্লু-বার্ড হাই স্কুলের এই বছর প্রতিষ্ঠা হয়। এই হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয় আরো অনেক বছর আগে যখন ড. আই এইচ ওসমানি সিলেটের জেলা প্রশাসক ছিলেন। কিন্তু নানা কারণে সম্ভবত জেলা শহরের এসব বিষয়ে নানা কোন্দলের কারণে উদ্যোগটি প্রায় ৭/৮ বছর পিছিয়ে যায়। একই বছর সিলেট স্টেডিয়াম স্থাপনের কাজও শুরু হয়। অবশ্যি অর্থাভাবে এই স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হতে প্রায় ৫০ বছর সময় লাগে। যাহোক, সিলেটে এখন ৪টি উন্নতমানের স্টেডিয়াম আছে। এইটি হলো লামাবাজার এলাকায় প্রতিষ্ঠিত পুরনো জেলা স্টেডিয়াম। আরেকটি হলো ২০১২ সালে সম্পূর্ণকৃত বিভাগীয় স্টেডিয়াম যেটা হচ্ছে ক্রিকেট খেলার জন্য নিবেদিত। আর তৃতীয় স্টেডিয়ামটি হয়েছে শহরের অন্য কোণে নবনির্মিত সুরমা সেতুর নিকটস্থ ক্রীড়া কমপ্লেক্স। শহরতলী শাহপরাণ এলাকায় আরেকটি স্টেডিয়াম অধুনা গড়ে উঠছে। এখানে বর্তমানে বাংলাদেশ ফুটবল একাডেমী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সিলেটে এছাড়া আরো দুটি খেলার মাঠ আছে। একটি হলো ফুটবল মাঠ যেটি শাহী ঈদগার সন্নিকটে মাত্র ৫ বছর আগে গড়ে তোলা হয়েছে। তবে সেখানে শুধু মাঠটিই আছে আর বিশেষ কিছু নেই। আর অন্যটি হচ্ছে এমসি কলেজ হোস্টেল এবং কলেজের মধ্যকার বিরাট ময়দান। অধুনা এই মাঠটিকে সংস্কার করা হচ্ছে এবং এটাকে কিভাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যায় সে সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা চলছে। সিলেট মহানগরে বস্তুতপক্ষে উন্মুক্ত কোন ময়দান নেই। সভা-সমিতি এবং মেলার জন্য প্রায়ই এই খেলার মাঠগুলোকে ব্যবহার করা হয় এবং তাতে মাঠ হিসেবে তাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়। সভা-সমিতির জন্য একটি উন্মুক্ত ময়দান খুঁজে বের করতে হবে। সম্ভবত দক্ষিণ সুরমায় এই রকম জায়গা পাওয়া যেতে পারে। অবশ্যি, একটি নতুন দুয়ার আগামী বছরে উন্মোচিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী বছর প্রায় ৩৬ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত কেন্দ্রীয় কারাগারটি শহরের বাইরে বাদাঘাটে স্থানান্তরিত হচ্ছে। তখন এই এলাকায় পরিকল্পিতভাবে পাবলিক পার্ক, খেলাধুলার জায়গা এবং সভা-সমিতির জন্য মাঠ, এমনকি নৌকা বিহারের জন্য ছোটখাটো হ্রদও সৃষ্টি করা যাবে বলে আমার মনে হয়। সিলেট শহরের বর্তমানে যে ঘিঞ্জি অবস্থা এবং বিশ্রী স্থাপনার যে আধিক্য পরিলক্ষিত হয় সেখান থেকে উন্মুক্ত পরিবেশ পাওয়ার সুযোগ একটি রয়েছে। আমার বিশ্বাস নগরবাসী অবশ্যি এই সুযোগটি গ্রহণ করবেন। এই অধ্যায়ের শুরু করেছিলাম একটি বিশেষ খবর দিয়ে। সেইটি হলো আমার বিয়ে। ১৯ নভেম্বর ঢাকায় বেইলি রোডে (বর্তমান অফিসার্স ক্লাবে) আমার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব সবাই ঠিক সন্ধ্যা ৬টার সময় বরযাত্রা শুরু করেন এবং আমরা ধানমন্ডিতে ৫ নং রোডে একটি খালি বাড়িতে বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য যাই। এই বাড়িটির মালিক ছিলেন আমার এক রকম দাদা বিচারপতি এস এম আকরাম। তিনি তখন লাহোরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠান নানাভাবে প্রলম্বিত হয়ে যায়। সুতরাং আমরা নতুন বৌকে নিয়ে সম্ভবত দুপুর রাতে বেইলি রোডে প্রত্যাবর্তন করি। পরের দিন ছিল ওয়ালিমা এবং তার জন্য সব ব্যবস্থাই বেইলি রোডে করা হয়। গাড়ি রাখার ব্যবস্থাও ছিল পুরনো বাড়িতে। কারণ, বাড়িটি ১৯৬১ সালে একটি বৃহৎ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। আমার ওয়ালিমা অনুষ্ঠানে কিছু ঝামেলার সৃষ্টি হয় যেহেতু সেদিন রাতেই সিলেট থেকে আগত অনেক আত্মীয়-স্বজন সিলেটের পথে ট্রেন ধরেন। আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণটি যথাযথ ছিল না বলেই এই অসুবিধা হয়। তাদের বাড়িতে যাওয়ার তাড়না ছিল এজন্য যে, ২৩ তারিখে আমার আব্বা সেখানে একটি উৎসবের আয়োজন করেন। সেটাও আবার দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল বিকেল ৪টায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য চা। আর অন্যটি ছিলো রাতে আত্মীয়-স্বজন এবং অন্যান্য অতিথিদের জন্য নৈশভোজ। আমার স্ত্রীকে আমি ভালই চিনতাম। তিনি ছিলেন আমার ফুপুতো বোন। কোন সময় যদি নির্ধারণ করা যায় তাহলে বলতে হবে, ১৯৫৮ সালে আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হই। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন এবং তখন থেকেই তারও বন্ধু মহলে আমাদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণের বিষয়টি মোটামুটি জানা ছিল। ১৯৬০ সালে আমি ঢাকায় পদায়িত হলে আমাদের সম্পর্কটি বিভিন্ন মহলে জানাজানি ও প্রচার হবার অতিরিক্ত সুযোগ পায়। আমার হবু স্ত্রী সে সময় ঢাকা রেডিও স্টেশনের নাটক অনুষ্ঠানে একজন নিয়মিত শিল্পী ছিলেন এবং সন্ধ্যার পর এই অনুষ্ঠান হত বলে আমি প্রায়ই তাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতাম এবং অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি পৌঁছে দিতাম। তাই আমাদের ভালবাসার খবরটি বহু বলয়ে জানা ছিল। আমাদের সম্ভাব্য বিয়েতে আমার পরিবার থেকে বেশ আপত্তি ছিল। এত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে বিয়েতে আমার পরিবারে মোটেই আগ্রহ ছিল না, যদিও সাবিয়া ব্যক্তিগতভাবে সকলের প্রিয়পাত্রী ছিল। আমার বড় বোন তাকে খুব পছন্দ করতেন এবং তাকে ভ্রাতৃবধূ হিসেবে গ্রহণে বেশ আগ্রহী ছিলেন। চলবে...
×