ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গারো নবান্ন উৎসব

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই ॥ তারানা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই ॥ তারানা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কোন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় আন্তরিক ও তৎপর। সরকার দেশের প্রতিটি ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর জন্য কাজ করছে। আমরা প্রত্যেকটি গোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে কাজ করছি। শুধু তাই নয়, সরকার সুষম পদ বণ্টনেও কাজ করে চলেছে। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁও বটমূলী অর্ফানেজ টেকনিক্যাল স্কুলে ঢাকা ওয়ানগালা-২০১৬ (গারো নবান্ন উৎসব) অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে ঢাকা ওয়ানগালা উদযাপন কমিটি। ঢাকা ওয়ানগালার নকমা সৌরিন আরেং সেংয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য জুয়েল আরেং এমপি, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক রেমন্ড আরেং, বাংলাদেশ খ্রীস্টান এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও, দি খ্রীস্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি:, ঢাকার প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুস গমেজ, ঢাকা ওয়ানগালার সাবেক নকমা শৈবাল সাংমা প্রমুখ। বিভিন্ন কোটায় গারো সম্প্রদায়ের কাজের সুযোগ রয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যখন চাকরির প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়, তখন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রয়োজনমাফিক আবেদনও পাওয়া যায় না। ফলে তাদের কোটাগুলো ফাঁকা রেখেই চাকরির নিয়োগ দেয়া হয়। তাই ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। যে কোন কাজে তাদের সুযোগ-সুবিধা সবসময় ছিল এবং থাকবে। ওয়ানগালার নকমা সৌরিন আরেং সেং বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সার্বিক দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। পরিবর্তন হয়েছে এদেশের সামাজিক চিন্তাধারার। আন্তর্জাতিকভাবে সম্মান বেড়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ জাতিগত ঐক্য তৈরি হয়েছে। আবহমান কাল থেকে এদেশের মানুষ ভালবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বাংলাদেশের শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে যে ভূমিকা রাখছে তা প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। ওয়ানগালাসহ বিভিন্ন সংস্কৃতি চর্চায় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সৌরিন আরেং সেং। আয়োজকরা জানান, ওয়ানগালা ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। আদিবাসী গারোদের বিশ্বাস, শস্য দেবতা বা ‘মিশি সালজং’ পৃথিবীতে প্রথম ফসল দিয়েছিলেন এবং তিনি সারা বছর পরিমাণ মতো আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি দিয়ে ভাল শস্য ফলাতে সহায়তা করেন। তাই নবান্নে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় ‘মিশি সালজং’কে ধন্যবাদ জানাতে উৎসবের আয়োজন করে গারোরা। ফসল দেবতাকে উৎসর্গ না করে তারা কোন খাদ্য ভোগ করে না। ‘ওয়ানগালা’ আদিবাসী মান্দি বা গারোদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। দেড় এক যুগ ধরে প্রতিবছর নরেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় বসবাসরত গারোরা এ উৎসব আয়োজন করছে। যুগ যুগ ধরে গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছে। খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গারোদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথাটি এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে করে পালন করা হয়। অর্থাৎ এক সময় তারা তাদের শস্য দেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রীস্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন। এ সময় সামাজিক নানা আয়োজনসহ ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানাদিও পালন করা হয়। উৎসব উপলক্ষে শুক্রবার রাজধানীর বটমূলী অর্ফানেজ টেকনিক্যাল স্কুল প্রাঙ্গণে জড়ো ঢাকায় বসবাসরত কয়েক হাজার গারো। শহুরে জীবনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে দিনভর তারা নিজেদের মতো করে আনন্দে মেতে থাকে। স্কুল মাঠে গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন পণ্যের অস্থায়ী স্টল। ওই সব স্টলে স্থান পায় গারো সংস্কৃতি ও আবেগবিজড়িত পোশাক, খাবার, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। খাবারের দোকানে ঘুরে ঘুরে স্বাদ নেয় নিজেদের ঐতিহ্যবাহী নানা পদের খাবারের। কেউ কেউ বাসায় খাবার জন্য কিনে নেন জুমের আলু, কুমড়া, শামুক, কাঁকড়া। ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, নতুন ধানের চালের গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে শস্য, বাড়ি ও মানুষের কপালে বা শরীরে ছাপ দেয়া হয়। ধূপ পুড়িয়ে, দামা বাজিয়ে রাজকীয় বেশে ‘নকমা’ বা সমাজ প্রধান ও ‘খামাল’ বা পুরোহিত নৃত্য করতে করতে গান গাইতে গাইতে দল বেঁধে রাজ্যের প্রজাদের নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় ‘দু’ বা মুরগি এবং ‘চু’ বা মদ দিয়ে তাততারা রাবুকা বা বাঁশ দিয়ে বানানো প্রতিমা রাক্কাসীর প্রতি ধন্যবাদ জানান। সঙ্গে নোকমি বা সম্প্রদায় প্রধানের স্ত্রীও থাকেন। আর পিছে থাকে কালো বা লম্বা বাঁশ দিয়ে বানানো বাঁশি, দামা বা লম্বা ঢোল, বোম বা মহিষের শিং দিয়ে বানানো বাঁশি নিয়ে রাজ্যের সাধারণ গারোরা। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জুম ওয়ানগালা আজ শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি গারোদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার এক অনবদ্য আন্দোলন বলে দাবি করেছে উপস্থিত গারোরা।
×