ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

চারুকলায় গম্ভীরা গানের সুরে মুগ্ধ শ্রোতা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

চারুকলায় গম্ভীরা গানের সুরে মুগ্ধ শ্রোতা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিকেল থেকেই গম্ভীরা গান শোনার আশায় চারুকলার বকুলতলায় জমতে থাকে শ্রোতার ভিড়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী এই বিশেষ আঙ্গিকের গানের টানে হাজির হতে থাকে শহুরে গানপ্রেমীরা। তবে আয়োজকদের উদাসীনতায় বিকেলের আয়োজনটি শুরু হয় সন্ধ্যা গড়ানোর পর। আর গান শোনার আগে শুনতে হয়েছে একঝাঁক বিশিষ্ট বক্তার বক্তৃতা। তবে সেই বিড়ম্বনায় ভোগা শ্রোতারাই পরিবেশনা শুরু হতে সবকিছু ভুলে মুগ্ধ হয়েছে সোঁদা মাটির গন্ধমাখা গম্ভীরা গানের সুরে। বিশেষ বাচনভঙ্গিতে কথার সঙ্গে সুরের সম্মিলন ও শিল্পীদের অভিব্যক্তির ছোঁয়ামাখা পরিবেশনায় আপ্লুত হয়েছে নাগরিক মন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় শুক্রবার থেকে শুরু হলো দুই দিনব্যাপী জাতীয় গম্ভীরা উৎসব। প্রথমবারের মতো উৎসবটির আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক সংগঠন দিয়াড়। দীর্ঘ বক্তৃতা পর্ব শেষে পরিবেশনা যখন শুরু হয় তখন ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা ৭টা। প্রথমেই মঞ্চে আসেন মাহবুব-মানীর নেতৃত্বাধীন চাঁপাই গম্ভীর দল। গম্ভীরা গানের উৎসবের তাৎপর্যটি তুলে কথা ও সুরে সম্মিলনে গেয়ে যায়Ñ হাঁরঘে দিয়াড় কর‌্যাছে এ আয়োজন/গম্ভীরা গানের উৎসবের হইলো সূচনা/গম্ভীরা তুলে ধরতে পারে সঠিক নিশানা। এরপর এই গানের ধারার বিকৃত উপস্থাপনার কথা তুলে ধরে তারা গেয়ে যায়Ñ এদিক-সেদিক যাদের নানা গম্ভীরা গান শুনা যায়/নিজের মতো গাইছে গম্ভীরা/ভাষার ঠিক-ঠিকানা নাই/কুনঠে গেলে গম্ভীরা গান/শুনে হলো বিদ্রোহী প্রাণ....। এভাবেই গম্ভীরা গানের ধারার মূল বিষয়সহ সামাজিক ও মানবিক নানা বিষয়কে আশ্রিত করে হেমন্তের সন্ধ্যা থেকে রাত দশটায় পর্যন্ত চলে উত্তরবঙ্গের সোঁদা মাটির গন্ধমাখা এই গানের আসর। সব মিলিয়ে ১০টি গম্ভীরা দলের অংশগ্রহণে সাজানো হয়েছে উৎসব। প্রথম দিনের আয়োজনে শ্রোতার মন রাঙায় পাঁচটি গম্ভীরা দল। দলগুলো হলো মাহবুব-মানীর চাঁপাই গম্ভীরা দল, রাজ্জাক-হিরকের নবাব গম্ভীরা দল, শিশুশিল্পী অয়ন-মীমের মহানন্দা শিশু গম্ভীরা দল, খাবির-সাইদুরের লোক গম্ভীরা দল ও সিরাজুল-হাসেমের সূর্যদিগন্ত গম্ভীরা দল। গানের একটি ধুয়া থাকে; সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে গানগুলো ধুয়ার সুরে গাওয়া হয়। এভাবে নানা-নাতির নাচ, গান, কৌতুক, অভিনয়, ব্যঙ্গ প্রভৃতির মাধ্যমে গম্ভীরা গানে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা হচ্ছিল। এ সময় তাদের বাকচাতুরি, উপস্থিত বুদ্ধি এবং অঙ্গভঙ্গি মুগ্ধতা ছড়াল শ্রোতা-দর্শকের হৃদয়ে। নানার পোশাক হলো লুঙ্গি; এ ছাড়া তার মুখে থাকে পাকাদাড়ি, মাথায় মাথাল, হাতে লাঠি; আর নাতির পোশাক ছেঁড়া গেঞ্জি, কোমরে গামছা। গম্ভীরা মানুষের কথা বলে। মানুষের সুখ-দুঃখ বর্ণনা করা হয় গানে গানে। শিক্ষামূলক বার্তাও প্রচার করা হয় গম্ভীরার গানে গানে। গম্ভীরার প্রধান দুই চরিত্র নানা আর নাতি। তাদের কথপোকথনের মাধ্যমে মানুষের জীবন, প্রেম, দুঃখ, অপমান, দেশপ্রেম সবকিছু ফুটিয়ে তোলেন। মানুষকে আনন্দে ভাসান। মূলত হিন্দু দেবতা শিবকে সন্তুষ্ট করার মধ্য থেকেই গম্ভীরার উৎপত্তি। শিবের অপর নাম ‘গম্ভীর’। গানে গানে তাকে সন্তুষ্ট করার মধ্য দিয়ে দেশ যেন সুজলা সুফলা হয় সেই প্রার্থনা জানানো হতো। এখন সেই গম্ভীরায় বর্ণিত হয় সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনার কাব্য। বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের অন্যতম ধারা গম্ভীরা। একে শিবের গাজন হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। মূলত এদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও ভারতের মালদা অঞ্চলে গম্ভীরার উৎস এবং প্রসার। শুক্রবার বিকেলে উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন বর্ষীয়ান নাট্যব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, বরেন্য দুই শিল্পী রফিকুন নবী ও হাশেম খান, গোলাম মোস্তফা এমপি প্রমুখ। শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন জনপ্রিয় গম্ভীরা শিল্পী প্রয়াত কুতুব-উল আলমের ছেলে সুজাতুল আলম কল্লোল। স্বাগত বক্তব্য রাখেন উৎসবের আয়োজক দিয়াড়ের সদস্য সচিব আনোয়ার হক। জাতীয়ভাবে লোকসংস্কৃতির আকর্ষণীয় অনুষঙ্গ নানা-নাতির গম্ভীরা উৎসবে শামিল হন এ গানের অনুরাগীরা। মমতাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, পঞ্চাশ বছর আগে আমি গম্ভীরা গানের উৎসব দেখেছি। তখন এত মানুষকে আগ্রহভরে এই গান শুনতে দেখিনি। গম্ভীরা হলো সরস আঙ্গিকের গান। সরল গান। হাস্যরস, তামাশা ও রহস্যময়তা ছড়িয়ে রয়েছে এ গানের পরতে পরতে। মূলত মানুষের কল্যাণ কামনায় এ গান গাওয়া হয়ে থাকে। রফিকুন নবী বলেন, চাঁপাইয়ের গম্ভীরা, কলাইয়ের রুটি এসব কিছুই আমাকে নস্টালজিক করে তোলে। দেশের মানুষ যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে তা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। আজ শনিবার উৎসবের সমাপনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। শনিবারও বিকেল ৪ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত চলবে উৎসব। সমাপনী দিনে গম্ভীরা পরিবেশনা করবে আরও পাঁচটি দল। দলগুলো হলো কল্লোল-সুমনের আদি গম্ভীরা দল, শাহ্জামাল-মনিরের রসকস গম্ভীরা দল, শিশ মোহাম্মদ-সিতেশের চাঁপাই নকশী গম্ভীরা দল, ইসমত-সাবিনার প্রভাতী গম্ভীরা দল এবং জাহাঙ্গীর-আজিমের পরিবেশনায় প্রয়াস ফোক থিয়েটার। শিল্পকলায় সুন্দরী নাট্যমেলা ॥ ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করে নাট্য সংগঠন নাট্যতীর্থ। পথচলার এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে দলটি আয়োজন করেছে সুন্দরী নাট্যমেলা। নারীকে মুখ্য করে নির্মিত ৬টি নির্বাচিত নাটকের এ নাট্যোৎসবের মূল আকর্ষণ সব নাট্য প্রযোজনা ‘সুন্দরী’ নামকরণে। ‘নারীর সৃজনে ঋদ্ধ বিশ্ব চরাচর’ সেøাগানে শুক্রবার শুরু হলো ছয় দিনের এই নাট্যমেলা। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে এ নাট্যমেলার আয়োজন করেছে নাট্যতীর্থ। শুক্রবার সন্ধ্যায় নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদারের পক্ষে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন রামেন্দু মজুমদার। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। তিনি বলেন, যখন পুরুষরা শিকারে ব্যস্ত ছিলেন তখন নারীরা শষ্যদানা কুড়াতেন। আজ সে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে নারী ঘর থেকে দেশে, দেশ থেকে বিদেশে নিজেদের কর্ম ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ঠিক সে সময় মুখ্য নারী চরিত্রের এ উৎসব ইতিবাচক। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় মঞ্চস্থ করে ‘শিবানী সুন্দরী’। দীর্ঘ ১৫ বছর পর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। সালাম সাকলাইন রচিত ও দিবাশীষ ঘোষ নির্দেশিত শিবানী সুন্দরী মহাকালের ১৭তম প্রযোজনা। নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুরেলা নাজিম, বেবী শিকদার, ফারুক আহমেদ সেন্টু, বাবু স্বপ্নওয়ালা, রিফাত। আজ শনিবার মঞ্চস্থ হবে বঙ্গলোক, কিশোরগঞ্জের প্রযোজনা ‘রূপচাঁন সুন্দরী’। রবিবার মঞ্চস্থ হবে নাট্যতীর্থের ‘কমলা সুন্দরী’, সোমবার একতা নাট্যগোষ্ঠী, কিশোরগঞ্জের ‘মহুয়া সুন্দরী’, মঙ্গলবার থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘আমিনা সুন্দরী’ এবং বুধবার উৎসবের সমাপনী দিনে মঞ্চস্থ হবে অনেষা থিয়েটার, ময়মনসিংহের প্রযোজনা ‘ভানু সুন্দরী’। এ উৎসবের অংশ হিসেবে আজ শনিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে ‘বাংলাদেশের নাটকে নারীর ভূমিকা ও ভবিষ্যত’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ড. মাহফুজা হিলালী ও সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব শুরু আজ ॥ বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের উদ্যোগে আজ শনিবার থেকে ঢাকায় শুরু হচ্ছে ১৪তম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব। রাজধানীর জাতীয় গ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে শনিবার বিকেলে উৎসব উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকার কথা রয়েছে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও চীনা চলচ্চিত্রকার বেজিং ফিল্ম একাডেমির অধ্যাপক ড. শি ফির। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এবার হীরালাল সেন স্মারক সম্মাননা প্রদান করা হবে চিত্রগ্রাহক আফজাল এইচ চৌধুরীকে। আয়োজকরা জানিয়েছেন, এবারের উৎসবের ভেন্যু ৬টি। জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তন ছাড়াও জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন ও সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তন এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে প্রদর্শিত হবে উৎসবের চলচ্চিত্রগুলো। এছাড়া উৎসব চলাকালীন ৩-৬ ডিসেম্বর রাজশাহীর লালন মঞ্চ ও বড়কুঠি মঞ্চে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। এবারের আসরে ১০৯টি দেশ থেকে ২৫৬৭ টি চলচ্চিত্র জমা পড়েছে। উৎসবে প্রদর্শনের জন্য ৫০০ টি চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়াও উৎসবে অস্কার, কান, সানড্যান্স, টিফ, ওবারহাওজেন, বার্লিন, লোকারনো, বুসানের মতো আলোচিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বেশ ক’টি নির্বাচিত স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হবে। এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিন ॥ শিল্পকলা একাডেমিতে চলমান ১৭তম দ্বিবার্ষিক এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের দ্বিতীয় দিনে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার। এতে ‘দ্যা সিটি ইন বাংলাদেশী আর্ট’ শীর্ষক মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে আলোচনা করেন স্থপতি সামসুল ওয়ারেস ও শিল্পী মোস্তফা জামান মিঠু। আজ শনিবার সেমিনারের দ্বিতীয় দিনে শিল্প সমালোচক জিয়াউল করিমের সভাপতিত্বে প্রথম অংশের আলোচনায় আলোচনা করবেন পোল্যান্ডের জাইমুন্ট রাফাল স্ট্রিরেন্ট ও কাতারের ড. নাদিরা। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত চারুকলা বিষয়ক সর্ববৃহৎ প্রদর্শনী চলবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
×