ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সৌন্দর্য হারাতে বসেছে দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তি, সচেতন মহল উদ্বিগ্ন

বাগেরহাটে ঐতিহাসিক চুনাখোলা মসজিদ এলাকায় পাকা স্থাপনা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

বাগেরহাটে ঐতিহাসিক চুনাখোলা মসজিদ এলাকায় পাকা স্থাপনা

বাবুল সরদার, বাগেরহাট থেকে ॥ বাগেরহাটে পঞ্চদশ শতকে নির্মিত ঐতিহাসিক চুনাখোলা মসজিদ সংলগ্ন কোর জোনে (প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা সুরক্ষার জন্য নির্ধারিত এলাকা) পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ করছে কতিপয় ব্যক্তি। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করে তারা এ কাজ করছে। মসজিদমুখী রাস্তা নির্মাণের পর থেকে ক্রমশ এ প্রবণতা বাড়ছে। ফলে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ অনন্য পুরাকীর্তি চুনাখোলা মসজিদটি তার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এ ঘটনায় সচেতন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াকাড়া ইউনিয়নের মরগা গ্রামে অবস্থিত চুনাখোলা মসজিদ। মসজিদটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ১২ দশমিক ৯ মিটার। সুলতানী আমলের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মসজিদের দেয়াল ২ দশমিক ৩৬ মিটার প্রশস্ত। ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে সুদৃশ্য পোড়ামাটির কারুকাজ (টেরাকোটা) সজ্জিত দুটি ছোট ও একটি বড় মেহরাব রয়েছে। অপর তিনদিকে তিনটি প্রবেশদ্বারসহ উত্তর-দক্ষিণে একটি করে মোট তিনটি দরজা রয়েছে। বক্র ছাদপ্রান্ত ও বাইরের দেয়ালের চতুর্দিকে সুদৃশ্য পোড়ামাটির আলপনা। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার অমূল্য এ স্থাপনাকে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি ঘোষণা করে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের হাতে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ন্যস্ত করে। ষাট গম্বুজ মসজিদ কমপ্লেক্স ও বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টডিয়ান গোলাম ফেরদৌস জানান, চুনাখোলা মসজিদের সৌন্দর্যবর্ধন, নিরাপত্তা ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কিছু উন্নয়ন প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন। এর আওতায় মসজিদের চারিদিকে সীমানা প্রাচীরসহ বাফার জোন ও কোর জোন তৈরি হবে। এজন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে। অধিগ্রহণযোগ্য জমি থেকে বাড়তি মুনাফা লাভের আশায় কতিপয় ব্যক্তি অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করছেন। বাগেরহাটের অধিকাংশ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতœস্থলের জমিজমা নিয়ে বিভিন্ন আদালতে এক বা একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। কোন কোন মামলা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সরেজমিন দেখা গেছে, চুনাখোলা মসজিদের গা ঘেঁষে পশ্চিম দিকে স্থাপনা নির্মাণ করছেন হান্নান শেখ। তাকে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ থেকে নির্মাণকাজ বন্ধে কয়েক দফা নোটিস করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কাজ বন্ধ না করে উল্টো আদালতে মামলা করেছেন। স্থানীয় মগরা গ্রামের হাফিজুর রহমান ও মুজিবুর রহমান জানান, স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে হান্নান গ্রামবাসীর কথায় কান দেননি। কেবল হান্নান নয় আরও কেউ কেউ পাকা ঘর তুলছে। মসজিদমুখী রাস্তা নির্মাণ শুরুর পর থেকে এ প্রবণতা বাড়ছে। মসজিদের কিছুটা সামনে আরেক ব্যক্তি ঘর তুলছেন। চুনাখোলা মসজিদ লাগোয়া স্থাপনা নির্মাণকারী জমির মালিক শেখ আব্দুল হান্নান বাগেরহাট সহকারী জজ আদালতে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করেছেন, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিতে বসবাসের জন্য তিনি স্থাপনা নির্মাণ করছেন। সরকার প্রয়োজনে এই জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এখন তাকে নিজ জমিতে নির্মাণ কাজে বাধা দেয়ার অধিকার প্রতœতত্ত্ব বিভাগের নেই। তিনি দাবি করেন, চুনাখোলা মসজিদ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত নয় এবং পুরাকীর্তি হিসেবে এটি গেজেটভুক্তও হয়নি। এ বিষয়ে ষাট গম্বুজ মসজিদ কমপ্লেক্স ও জাদুঘরের কাস্টডিয়ান মোঃ গোলাম ফেরদৌস বলেন, হান্নানকে কয়েক দফা নোটিস করা হয়েছে। কিন্তু নোটিস অগ্রাহ্য করে তিনি কাজ অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে তিনি আদালতে আমাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছেন। আমরা যথাসময়ে আদালতে আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করব। বিশ্ব ঐতিহ্য ষাট গম্বুজ মসজিদ, ঐতিহাসিক চুনাখোলা মসজিদ, খানজাহানের মাজার, মাজার সংলগ্ন একগম্বুজ মসজিদ, বড় আদিনা ঢিবি, খানজাহানের বসতভিটা, খানজাহানের প্রাচীন রাস্তাসহ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত নিদর্শন ও পুরাকীর্তি নিয়ে মামলাগুলো মূলত ভূমি মালিকদের পুরাকীর্তি আইনের লঙ্ঘন ও অধিদফতরের হস্তক্ষেপের কারণে হয়েছে। এসব মামলার কারণে স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তাই জাতীয় ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি রক্ষায় সবাইকে আরও আন্তরিক ও সচেতন হয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। ঐতিহাসিক মত অনুযায়ী, বর্তমান মগরা গ্রামের পাশে চুনাখোলা মসজিদের এ এলাকায় হযরত খানজাহান (র) তার বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় চুন উৎপাদন কেন্দ্র বা চুনখোলা স্থাপন করেছিলেন। সে কারণে এ মসজিদটি চুনাখোলা মসজিদ নামে পরিচিত। ইউনেস্কো ঘোষিত বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি বাগেরহাটের ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহর।’ যেখানে বিশ্বখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদসহ তৎকালীন খলিফতাবাদ নগরের আরও কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন ও অনুপম কারুশৈলীর কয়েকটি মসজিদ রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেযোগ্য নিদর্শনগুলো হলোÑ খানজাহান নির্মিত ষাট গম্বুজ মসজিদ, বিবি বেগনি মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, জিন্দাপীর মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, রেজা খোদা মসজিদ, রণবিজয়পুর মসজিদ, সাবেক ডাঙ্গা মনুমেন্ট ও সিঙ্গাইর মসজিদ। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া ১৫টি ঐতিহাসিক নগরীর অন্যতম মধ্যযুগীয় শহর খলিফতাবাদ। হযরত খানজাহান (র) নির্মিত প্রাচীন এ শহরকে ১৯৮৫ সালে এতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ৩২১ নম্বর ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ইউনেস্কো। ‘অচিন পাখির’ সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, বিশ্ব ঐহিত্যের এ মসজিদটি দেখতে প্রতিদিনই দেশী-বিদেশী পর্যটকরা মগরা গ্রামে আসেন। এ মসজিদ লাগায়ো স্থাপনা নির্মাণে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
×