ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গফরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধা এবি সিদ্দিক শোনালেন সহযোদ্ধার শহীদ হওয়ার কথা

শেষ গুলিটা লাগল ওর বুকে... কাশেদ লুটিয়ে পড়ল আমার কোলে

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

শেষ গুলিটা লাগল ওর বুকে... কাশেদ লুটিয়ে পড়ল আমার কোলে

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘ওরা মার্চ করছে। আমরাও সামনের দিকে এগিয়ে যাই। উভয়পক্ষ প্রায় কাছাকাছি চলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। ফাঁকা মাঠ। আমি গাছের আড়াল থেকে ফায়ার করতে থাকি। একটি গুলি এসে লাগে মুক্তিপাগল কাশেদের ডান পায়ে। তারপর ডান হাতে। দেখতে পাই গুলি লাগায় সে আর ফায়ার করতে পারছে না। তাকে উদ্ধারের জন্য তার কাছে এগিয়ে যাই। দু’জনের কোমরে গামছা বাঁধি। টেনেহিঁচড়ে পেছনে আনার চেষ্টা করি। চারদিকে মুহুমুর্হু গুলির আওয়াজ। তখন মুক্তিযোদ্ধা কাশেদ বলতে থাকল- তোমরা নিজেদের জান রক্ষা করো। যতক্ষণ দেশ স্বাধীন না হয় ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এই কথা বলার মুহূর্তেই আরেকটা গুলি এসে লাগে কাশেদের বুকে। ছটফট করতে করতে হাসিমুখে দেশের তরে প্রাণ বিলিয়ে দেন মুক্তি কাশেদ।’- মহান বিজয়ের মাসে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়ার কথা জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা এ বি সিদ্দিক। যুদ্ধে অংশ নেয়ার অপরাধে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার এই মুক্তিযোদ্ধাকে হারাতে হয় তার বাবাকে। ছেলে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে শুনে সিদ্দিকের বাবা জাফর আলীকে বাঘবাড়ি গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানী হায়েনারা। রাজাকারদের সহায়তায় তাকে স্থানীয় কান্দিপাড়া বাজারে নিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্মৃতির পাতা উল্টে কথাগুলো বলতে গিয়ে বার বার থেমে যাচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক। চোখে জমে ওঠা জল, দুঃসহ স্মৃতির কষ্টকথা বহু বছর পর পেয়ে বসে তাকে। এক প্রশ্নের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক বলেন, ‘দিন তারিখ মনে নেই। তবে যুদ্ধের প্রথমদিকে। দত্তনাপাড়া হাই স্কুল মাঠে বাঙ্গালকান্দি গ্রামের আবুল কাশেদের নেতৃত্বে মিটিং করি। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি। উঠিয়া বাজারেও মিটিং হয়। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, এখান থেকেই কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করব। তারপর যাই পাইথল। সেখানে যাই মূলত অস্ত্র যোগাড় করার জন্য। তিনটা অস্ত্র ছিল। তাই আমরা তিনজন যাই। আমি, মাইজবাড়ি গ্রামের আতাউল গণি (রুপা মিলিটারি) ও মুক্তি কাশেদ। সেখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সেখানেই মারা যান মুক্তি কাশেদ।’ পাইথলে ঘটে যাওয়া ওই সম্মুখযুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘একের পর এক গুলি। চারদিকে গুলির আওয়াজ। শেষ গুলিটা এসে লাগে মুক্তি কাশেদের বুকে। তখন বাধ্য হয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে বিল পার হয়ে একটা বাড়িতে আশ্রয় নিই। আমি তখন উলঙ্গ, কাপড় আছে কি নাই তা বলতে পারব না। ওই বাড়ির একটা মেয়ে এগিয়ে এসে তার ওড়না দিল। তা দিয়েই লজ্জাস্থান ঢাকলাম। পরে সেখান থেকে পাইথলের ছামাদ চেয়ারম্যানের বাড়িতে আশ্রয় নিই। তারা আমাকে নদীর ওপারে নিয়ে যায়। ওপারে যাওয়া মাত্রই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।’ সহযোদ্ধাকে হারিয়ে তারা দ্বিগুণ শক্তিতে একত্রিত হতে থাকে। দলে ভিড়তে থাকে মুক্তিকামী জনতা। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করে বাঘবাড়ি গ্রামের এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘তারপর আমরা আবার সংগঠিত হই। ৭০ জন একত্রে ভারত যাই। কিন্তু ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছার আগেই বাবার মৃত্যু সংবাদ পাই। শুনতে পাই বাবাকে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানীরা। তখন তিন-চার জন আমাকে নিয়ে দেশে চলে আসে। বাবার মৃত্যুর পর দেশে ফিরে ইকবাল-ই-আলম কামাল কোম্পানি কমান্ডারের দলে যোগ দিই। শেষ পর্যন্ত ওই দলের হয়েই যুদ্ধ করি।’ যুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনা করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আমাদের ঘরবাড়ি নষ্ট না হলেও যুদ্ধে অংশ নেয়ার কারণে বাবাকে হারিয়েছি। ওরা আমার বাবাকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে স্থানীয় কান্দিপাড়া বাজারে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে বাঙ্গালকান্দি গ্রামের মোসলেম সাহেবকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। পুরো গফরগাঁওয়ে প্রথমে তাদের দুজনকে হত্যা করা হয়। তারপর কত মানুষকে যে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে সে হিসাব জানা নেই। তিনি বলেন, মাইজবাড়ি গ্রামে কামাল ভাইয়ের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়, পুড়িয়ে দেয়া হয় আতাউল গণির বাড়ি। মাইজবাড়ি বাজার ও কান্দিপাড়া বাজারও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। শত শত মানুষ পালিয়েছিল ঘর ছেড়ে। যুদ্ধে অংশ নিতে কিভাবে অনুপ্রাণিত হলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ করতে যাই।’ পরিবার থেকে কোন বাধা এমন প্রশ্নে তার উত্তর, ‘না। মূলত বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে চলে যাই।’ এখন আছেন কেমন এমন প্রশ্নে তার উত্তর, ‘২০০২ সাল থেকে আমি প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছি। কিছু সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিলাম স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা অফিস ও থানায়। তবে তাতে সাড়া পাইনি। অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিধান রয়েছে। এরশাদ পিরিয়ড ও বিএনপি আমলে আমরা ছিলাম অবহেলিত। আর্থিকভাবে আসলে আমি খুব অসুবিধায় আছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার প্রাপ্তি অনেক। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আমার দুই ছেলের চাকরি হয়েছে। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি।’ মাসিক ভাতা বাদে সরকারী অন্য কোন বরাদ্দ পাচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নে এই মুক্তিযোদ্ধা জানান, ‘সরকারীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি করে দেয়ার কথা রয়েছে। অথচ গফরগাঁওয়ে একটি বাড়িও বরাদ্দ হয়নি, পার্শ্ববর্তী সব উপজেলায় হয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নেতৃত্বের ব্যর্থতা রয়েছে।’
×