ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সকল পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা;###;পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকেও বিশেষ বার্তা দিয়েছে দিল্লী

তিস্তার জট খুলছে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

তিস্তার জট খুলছে

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে ভারত। সকল পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে বলেও জানিয়েছে দেশটি। এছাড়া তিস্তা চুক্তির বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও বিশেষ বার্তা দিয়েছে দিল্লী। ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদমন্ত্রী সঞ্জীব কুমার বালিয়ান শুক্রবার লোকসভায় একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে ভারত সরকার উদ্যোগী। সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান সূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে এমন বার্তা দিল দিল্লী। ভারতের কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, পানিসম্পদমন্ত্রীর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে মমতাকে মোদি সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ বার্তা দেয়া হয়েছে। কেননা, সন্ত্রাস ও জঙ্গী প্রতিরোধ ইস্যুতে ঢাকাকে পাশে চায় দিল্লী। সে কারণে দুই দেশের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চান নরেন্দ্র মোদি। আর ভারতের নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সে কারণে কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে, শেখ হাসিনার আসার আগেই তিস্তা চুক্তির একটি রফাদফা করতে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ভারতের নোট বাতিলের প্রেক্ষিতে মোদির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তবে দিল্লী চাইছে, মমতাকে সঙ্গে নিয়েই তিস্তা সমস্যার সমাধান করতে। সে কারণে মমতাকে পাশে চান মোদি। তিস্তা চুক্তি সম্পন্নের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছে দিল্লী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১৭ ডিসেম্বর দিল্লী যাচ্ছেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার ঢাকা সফরকালে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রত্যাশা করছেন, তিনি (শেখ হাসিনা) যেন ভারত সফর করেন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তির জট খুলতে কাজ শুরু করেছে ঢাকা-দিল্লী। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে একাধিকবার আলোচনাও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক গত ৮-১০ নবেম্বর দিল্লী সফর করেন। সেখানে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ড. জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরকালে কি কি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে, সে বিষয়েও আলোচনা করেন দুই পররাষ্ট্র সচিব। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বলেছেন, ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করবেন। সে সফরের সময় তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক সমাধান আসবে বলে আমি আশাবাদী। বাংলাদেশ ও ভারতের মাইন্ডসেট ঠিক আছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের কোন আপত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যেটুকু সমস্যা আছে তা সমাধান হবে। তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ঢাকার প্রস্তুতি রয়েছে। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত ছিল। সেটিতেই বাংলাদেশের সম্মতি রয়েছে। তাই নতুন করে চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করতে হবে না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ম্যানেজ করতে পারলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের সময় তিস্তা চুক্তি করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যার মধ্যে একটি ছিল সীমান্ত চুক্তি, অপরটি তিস্তা চুক্তি। তবে নানা কারণে এই দুটি চুক্তি একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এখনও তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। আর তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে এক সময় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গকে পাশ কাটিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে পারছে না মোদি সরকারও। তাই যেভাবেই হোক মমতাকে রাজি করিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে চায় দিল্লী। সে কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছর ৬ জুন ঢাকা সফরে এলে মমতাকেও সফরসঙ্গী করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা-মোদির একসঙ্গে বৈঠকও হয়। বৈঠকে ভারতের দুই নেতাই তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করে আসছেন, সিকিম থেকে তিস্তায় পানি সরবরাহ কমে আসছে। কেননা, সিকিম সরকার তিস্তার মুখে চারটি বাঁধ দিয়ে বড় বড় বিদ্যুত প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ওই বাঁধের কারণেই শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি আসে না। তাই তিস্তা চুক্তি হওয়ার আগেই সিকিম থেকে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে চান মমতা। তিনি বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও জানিয়েছেন। এছাড়া মমতা নিজেও সিকিম সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার জন্য আগ্রহও প্রকাশ করেছেন। তবে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং জানিয়েছেন, সিকিমের বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য তিস্তায় পানিপ্রবাহ কমছে না। বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য তিস্তা থেকে নেয়া পানি আবার তিস্তায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে তার কোন আপত্তি নেই বলেও জানান তিনি। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা কখনই বলেননি যে, তিনি এই চুক্তির বিপক্ষে। তিনি সব সময় বলে আসছেন, তিস্তা চুক্তিতে তিনি আগ্রহী। তবে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখেই তিস্তা চুক্তিতে আগ্রহী বলে মমতা জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি করে তিনি তিস্তা চুক্তির পক্ষে আগ্রহী নন। আর সিকিম থেকে ঠিকমতো পানি পেলেই পশ্চিমবঙ্গের এ বিষয়ে কোন আপত্তি নেই বলেও মমতা জানিয়েছেন। দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্র জানায়, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে পাশে রেখেছিলেন, মোদিও ঠিক সেভাবেই মমতাকে পাশে রেখে তিস্তা চুক্তি করতে চাইছেন। তিস্তায় যাতে উজান থেকে বেশি পানি আসে সেই পানি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ তাদের হিস্যা পায় সেজন্য সিকিমের সঙ্গেও আলোচনা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেননা, সিকিমের পানিই তিস্তায় প্রবাহিত হচ্ছে। কোন বাধা ছাড়াই সিকিমের পানি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে আসতে পারে, সেটাই নিশ্চিত করতে আগ্রহী মোদি সরকার। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে আপত্তি তোলায় বিষয়টি আটকে যায়। এর প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় গত বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা এসে শীঘ্রই তিস্তার জট খোলার আশা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর মোদির ঢাকা সফরের সময় মমতারও আসার আলোচনা শুরু হলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আবারও বেঁকে বসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি না করার আশ্বাস দিয়েই প্রধানমন্ত্রী মোদি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে সফরে আসতে রাজি করান। ভারতের মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি বিষয় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করলে সীমান্ত চুক্তি ও তিস্তা জট খোলার আশা তৈরি হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ অধিবেশনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে তিস্তা চুক্তি সইয়ের বিষয়েও জোর চেষ্টা চালানোর আশাও দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এদিকে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে মমতা বাংলাদেশ সফর নিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে মমতা লেখেন, তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে তার বিরোধিতা নেই। এই চুক্তির জট খুলতে তিনি মোদিকে সহযোগিতা দিতেও প্রস্তুত রয়েছেন। চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর ভারতের গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনে যোগদানের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটি সফরের জন্য শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছর ৬-৭ জুন বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। আসন্ন ভারত সফর হবে মোদি সরকার ক্ষমতায় বসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। যদিও ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির স্ত্রীর মৃত্যুর সময়ে শেখ হাসিনা সংক্ষিপ্ত সফরে দিল্লী গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে সন্ত্রাস দমনে দুই দেশ পরস্পরকে সমর্থন করছে। রাজধানীর গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার পর মোদি এক বার্তায় শেখ হাসিনার পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করেন।
×