ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত দিবস

প্রকাশিত: ০০:৫৪, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত দিবস

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও ॥ আগামীকাল ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে ঠাকুরগাঁও মহকুমা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও উদ্যোমী জনতা ওই দিন ভোরে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে বিজয় উল্লাস করে। ২৭ মার্চ পাক বাহিনীর সরাসরি গুলিতে প্রথম শহীদ হয় রিক্সা চালক মোহাম্মদ আলী। পরদিন ২৮ মার্চ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করায় শিশু নরেশ চৌহানকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনীর সদস্যরা। পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মুক্তাঞ্চল থেকেই পরিচালিত হয় চূড়ান্ত লড়াই। ১৫ এপ্রিলের পর ঠাকুরগাঁও এলাকায় শুরু হয় হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট আর বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা। আওয়ামীলীগের ঘাটি শহরের ইসলাম নগর থেকে ছাত্র নেতা আহাম্মদ আলীসহ ৭ জনকে হানাদার বাহিনী ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে ধরে এনে আটক করে রাখে। পরে বেয়ানেট চার্জ করে হত্যার পর তাদের লাশ শহরের টাঙ্গণ ব্রিজের পশ্চিম পাশে গণকবর দেয়। একইভাবে তৎকালীন এমপি আলহাজ্জ ফজলুল করিমের কয়েকজন চাচাত ভাই সহ ৬জনকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৭ এপ্রিল সেখানে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ২ হাজার ৬শ’ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে পাথরাজ নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে। এদিনে জগন্নাথপুর, গড়েয়া শুখাপনপুকুরী এলাকার কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষ ভারত অভিমুখে যাওয়ার সময় রাজাকাররা তাদেরকে আটক করে মিছিলের কথা বলে পুরুষদের লাইন করে পাথরাজ নদীর তীরে নিয়ে যায় এবং পাক হানাদাররা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে তাদের। স্বামী হারিয়ে সে দিনের বিভৎস ক্ষত নিয়ে এখনও বেঁচে আছে ৪ শতাধিক বিধবা । দ্বিতীয় গণহত্যা চালানো হয় রানীশংকৈল উপজেলার খুনিয়াদিঘীর পাড়ে। মালদাইয়া বলে পরিচিত স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার নিরিহ লোকজনকে ধরে নিয়ে যেতো ওই পুকুরের পাড়ে। সেখানে একটি শিমুল গাছের সাথে হাতে পায়ে লোহার পেরেক গেঁথে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে বর্বর নির্যাতন চালাতো লোকজনের উপর। তারপর লাইন করে দাঁড় করিয়ে সাধারণ মানুষকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করা হতো। মানুষের রক্তে এক সময় লাল হয়ে উঠে ওই পুকুরের পানি। তাই পরবর্তীতে এ পুকুর খুনিয়াদিঘি নামে পরিচিত হয়ে উঠে। এভাবে তারা রুহিয়া রামনাথ হাঠ, ফারাবাড়ী,রোড,ভাতারমারি ফার্ম, ভোমরাদহ ও বালিয়াডাঙ্গী এলাকায় গনহত্যা চালায়। ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তি বাহিনীর সাথে পাকিস্তানী বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয় জুলাই মাসের প্রথম দিকে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গেরিলারা হানাদার বাহিনীর ঘাটির উপর আক্রমন চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বেশ কিছু ব্রীজ ও কালভার্ট উড়িয়ে দেয় তারা। দালাল রাজাকারদের বাড়ি ও ঘাটিতে হামলা চালায়। নবেম্বর মাসের ৩য় সপ্তাহ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক অভিযান চালায়। মুক্তি বাহিনীর যৌথ অভিযানে পঞ্চগড় মুক্তিবাহিনীর দখলে আসলে পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। এরপর ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমন শুরু হয় ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে। মিত্রবাহিনী যাতে ঠাকুরগাঁও দখল করতে না পারে সেজন্য পাকসেনারা ৩০ নবেম্বর ভূল্লী ব্রীজ উড়িয়ে দেয়। তারা সালন্দর এলাকায় সর্বত্র বিশেষ করে ইক্ষু খামারে মাইন পুতে রাখে। মিত্রবাহিনী ভূল্লী ব্রীজ সংস্কার করে ট্যাংক পারাপারের ব্যবস্থা করে। ১ ডিসেম্বর ভূল্লী ব্রীজ পার হলেও মিত্রবাহিনী যত্রতত্র মাইন থাকার কারণে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকতে পারেনি। ওই সময় শত্রুদের মাইনে ২টি ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর এফ এফ বাহিনীর কমান্ডার মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে মাইন অপসারণ করে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ২ ডিসেম্বর সারারাত প্রচন্ড গোলাগুলির পর শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে শত্রুমুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও। তখন মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের জনগণ মিছিলসহ ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। বিজয় ছিনিয়ে আনতে ১০ হাজার নারী পুরুষকে প্রাণ দিতে হয়। পাশবিক নির্যাতনের শিকার ২ হাজার মা-বোন। এ ব্যাপারে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জীতেন্দ্র নাথ রায় জানান, বর্তমান সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে যেমন স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদরদের বিচার করা হচ্ছে জেলা পর্যায়েও যেন ট্রাইবুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। এলাকার মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিটি এলাকায় যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের দাবী জানান। প্রতিবছরের মতো এবারো উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হানাদার মুক্ত দিবস পালনে গ্রহণ করেছে দিনব্যাপী নানা কর্মসুচি। এতে মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিককর্মী ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ শতস্ফুর্তভাবে অংশ গ্রহণ করে বলে জানান জেলা উদীচী’র সভাপতি সেতারা বেগম।
×