ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাসান হাবিব

বই.... ॥ নারীর সংগ্রাম নারীর আধুনিকায়ন

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

বই.... ॥ নারীর সংগ্রাম নারীর আধুনিকায়ন

নারীবাদ কোন ধারণা নয়। এটি এখন আদর্শ হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। নারীবাদ আন্দোলন হিসাবে এখন সারাবিশ্বে অধিক জনপ্রিয় তাতে সন্দেহ নেই। আমরা জানি, ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে নারীর কর্মসংস্থান হেতু অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে নারীবাদ আন্দোলন হিসাবে সামনে আসে। তবে নারীবাদ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে মেরি ওলস্টনক্রাফটের ‘অ ঠরহফরপধঃরড়হ ড়ভ ঃযব জরমযঃং ড়ভ ড়িসধহ’- বইটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এর আগে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে নারীর সমান অধিকার প্রশ্নে অলিম্প দ্য গজ- এর ‘উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব জরমযঃং ড়ভ ড়িসধহ’-নামে একটি বই অবশ্য প্রকাশিত হয়। তবে বিশ্বে নারীবাদের পথিকৃত হিসাবে মেরি ওলস্টনক্রাফটের বইটিকেই অধিক হিসাবে উল্লেখ করা হয়। আর বাঙালী সমাজে নারীবাদ ধারণাটি শুরু হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। তবে নারীর অবস্থান ও নির্মাণ প্রশ্নে বাঙালী সমাজ ও পাশ্চাত্য সমাজ দুটি ভিন্ন ধারায় এগিয়ে আসে। নারীবাদের সূচনা ও প্রতিষ্ঠার চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে গোলাম মুরশিদের ‘আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণী’- বইটি নিয়ে এ ক্ষুদ্র আলোচনার প্রয়াস। আলোচনার প্রথমে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাঙালী নারী যুগে যুগে যতটা উপেক্ষিত থেকেছে তার ইতিহাস শুধু যে বাঙালী নারীর অবস্থানকে দুর্বল রেখেছে তা নয় বরং সেখানে পুরুষ থেকেছে একটি অবাঞ্ছিত সহযোগী হিসাবে যার পরিবর্তনও চেয়েছে স্বয়ং পুরুষ। সম্ভবত গোলাম মুরশিদের বাঙালী সমাজে নারীর অবস্থান ও নির্মাণ অনুসন্ধানে এ বিষযটি উঠে এসেছে। এখানে বলা দরকার, গোলাম মুরশিদ একজন শক্তিমান গবেষক। তিনি তাঁর ‘আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণী’- গ্রন্থে বাঙালী সমাজে নারীর ‘আধুনিকায়ন’-কে অত্যন্ত সত্য নির্ভর, তাত্ত্বিক ও তথ্যের অন্তর্জালে তুলে এনেছেন যা বাঙালী নারীর ইতিহাস, মনোভাব ও পরিবর্তনের অনুসন্ধানে এটিকে আকর গ্রন্থ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। তিনি তাঁর এ গ্রন্থে বাঙালী নারী সমাজের পরিবর্তনকে ‘নারীমুক্তি’ না বলে ‘আধুনিকায়ন’ শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে, ‘নারীমুক্তি’ শব্দটি যেভাবে ‘ষরনবৎধঃরড়হ’ শব্দটিকে পায় সেটি ব্যাপক ও বৈপ্লবিক অর্থে বুঝায়। তাঁর ভাষায়, ‘আমার কাছে ‘নারীমুক্তি’ শব্দটি যথাযথ মনে হয়নি; কারণ, গোড়াতে এ শব্দের অর্থ যা-ই থাক না কেন, এ শব্দের দ্বারা এখন নারীদের এমন এক ধরনের আধুনিকতা বোঝায়, যা বিশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাঙালী মহিলারা আয়ত্ত করতে পারেননি। সন্দেহ হয়, এক শতাব্দী পরে এখনও তাঁরা সে পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন কি না।’ কারণ বাঙালী নারীর পরিবর্তনটি এখনও একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসাবে রয়ে গেছে। আমরা বাঙালী নারীর পরিবর্তনে যে বিষয়টি উৎসাহ ও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি তা হলো, তাদের পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি মূল্যবোধের প্রশ্নে যতটা এগিয়েছে সেখানে শত শত বছরের ধর্মাচারের প্রশ্নে ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। এটা যে ধর্মের কোন অংশ নয়- তা যতটা রক্ষণশীল সমাজকে বুঝানো জরুরী হয়ে পড়ে তার থেকে কোনভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি ধর্ম। কিন্তু এখানে রক্ষণশীল সমাজ তার চরিত্র পাল্টে মুক্তি বা বসধহপরঢ়ধঃরড়হ-এর স্বাদ পেতে নারীর কথা যে ভেবেছে তা নয় বরং বসধহপরঢ়ধঃরড়হ-কে তার নিজস্ব লক্ষ্য তথা উপযুক্ত সম্ভোগের বস্তু ভেবে রেখেছে। তবে এটি ঠিক যে, উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যে সব পুরুষ নারীকে অন্তঃপুর থেকে মুক্ত করা, শিক্ষিত করা, সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেছেন সেখানে নারী তাঁর উপযুক্ত হয়ে ওঠার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছেন সেই পুরুষেরই। ফলে আধুনিক হওয়ার সকল প্রক্রিয়ায় সচেতন ভাবেই পুরুষের চেলেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছে নারীকে। এ কথা ঠিক যে, নারীর সঙ্কটে নারীই নিবিষ্ট হয়েছে পুরুষের রূঢ় অবস্থানের মধ্য দিয়ে; সেখানে পুরুষের দ্বিযুক্তি থাক বা না থাক। আমরা এখানে দেখি, বইয়ের পাঁচটি অধ্যায়ে লেখক বাঙালী নারীর পরিবর্তনকে একেকটি সত্যাসত্যের ধাপকে যে সব শিরোনামে সাজিয়েছেন; সেখানে বাঙালী সমাজে যে সব পুরুষ নারীকে ভেবেছেন অবরুদ্ধ অন্তঃপুর বাসিনী, আবার সেটিকে তাঁর জন্য ভেবেছেন অনুপযুক্ত কিন্তু শঙ্কাযুক্ত থেকেছেন তাঁর ‘অবাধ্যতা’র (!) পরিবর্তন নিয়ে। এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয়, বাঙালী নারী শিক্ষার জন্য বাইরে আসা অথবা শুধুমাত্র একটি পোশাকি ভঙ্গিকে পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট মনে করেননি সেখানে পুরুষ তাঁর ‘নারীবাদী’ সংস্কারকে ংবীঁধষ সুবিধার ধারপ্যাঁচে ভেবেছেন বারবার। তবে নারীবাদের জন্য ‘সংস্কার’ শব্দটিকে রাজনীতি অথবা ধর্মের ছায়া দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা বললেও নারী পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার মতো কোন উচ্চকিত পথ নারীর জন্য কখনও খোলা থাকেনি অন্তত বাঙালী সমাজে। ফলে যে সব নারী ভেবেছেন নারীকে নারী থাকার জন্য নয়- সে সব পরিবর্তন একটা সময় ‘পুরুষালী’-তে ‘নারীবাদী’ পুরুষদের মাথা খেচিয়ে তুলতে যথেষ্ট। তাতে নারীর আধুনিকায়নে শত শত বছরের ‘পুরুষ’টি তাঁর পুরুষ হয়ে নারীকে নারীজগতে রাখতে চাইবেন বটে কিন্তু নারী প্রগতির অমিমাংসিত সত্যগুলো ঠিকই খুঁজে নিয়েছেন তাঁরই পরিবর্তনের জন্য। এ প্রসঙ্গে আমরা দেখি, লেখক গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘আধুনিকতার অভিঘাতে বাঙালী রমণী’র পঞ্চম অধ্যায়ে ‘প্রভুর পথে, প্রভুর চোখে’ -একটি চমকপ্রদ শিরোনামের আলোচনায় বেশ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। বইটির পাঁচটি অধ্যায়ে শিরোনামসহ সবিস্তারে আলোচনা ছাড়াও ‘পরিশিষ্ট’ অংশে ছয়টি ক্রমধারায় বাঙালী নারী সমাজের আধুনিকায়ন নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও তথ্য রয়েছে। যেমন ‘বাঙালী নারীদের আধুনিকায়ন এবং ঠাকুর পরিবার’, ‘বামাবেধিনী পত্রিকা, ১৮৬৩-১৯২৩’, ‘সখি সমিতির সদস্যবৃন্দের তালিকা, ১৮৯১’, ‘লেখিকাদের একটি নির্বাচিত তালিকা, ১৮৬৩-১৯০৫’ ইত্যাদি। এ বইটি বাঙালী নারীদের আধুনিকায় ও পরিবর্তনের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক স্মারক তাতে সন্দেহ নেই। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। বইটির বর্তমান সংশোধিত সংস্করণ এনেছে প্রথমা প্রকাশন।
×