ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নুরুল করিম নাসিম

জার্নাল ॥ কবি শামসুর রাহমানের বাড়ি

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

জার্নাল ॥ কবি শামসুর রাহমানের বাড়ি

বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিংয়ের কোনার টেবিলে কবি আবুল হাসান, কবি শশাংক পাল আর আমি তুমুল আড্ডায় মেতে উঠেছি। শহরে সন্ধ্যা তখন অতিক্রান্ত। সময়টা উন্মাতাল ঊনসত্তর। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে কোথা থেকে আহমেদ ছফা ভাই ছুটে এলেন তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো শহরে কোথাও কিছু একটা ঘটেছে। আগেই আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল তখন তিনি পুরান ঢাকার নারিন্দার মনির হোসেন লেনের একটি মেসে থাকেন। ‘ফাউস্ট’ অনুবাদ সবেমাত্র হাত দিয়েছেন। প্রথম উপন্যাস সূর্যতুমি মাথি-এর পান্ডুলিপি পরিমার্জনা করছেন। প্রুফ দেখে আয়-উপার্জন করছেন। আমি তখন নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডের বাসা ছেড়ে নিজেদের সদ্য কেনা বাড়ি বেগমগঞ্জ লেনে থাকি। আমি উঠে দাঁড়ালাম। হাসান আর শশাংক চাইছিল না আমি আড্ডা ভেঙ্গে চলে যাই। আমি তখন অসহায় আমার অন্য কোন বিকল্প নেই। আগেই ছফা ভাইকে কথা দিয়েছি। সেই মোতাবেক কবি শামসুর রাহমানের আশেক লেনের বাড়িতে যাওয়ার জন্য এ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছে। ছফা ভাই তাড়া দিতে লাগলেন। হাসান বলল, ছফা ভাই একটা কাটলেট খাব। তিনি অর্ডার দিয়ে কাউন্টারে বিল দিয়ে গেলেন। আশেক লেন লায়ন সিনেমার গলিতে। ছফা ভাই হাঁটতে পছন্দ করতেন। তখন ঢাকা শহরে এত ভিড়, মানুষজন, গাড়ি-ঘোড়া ছিল না। আমরা বাংলাবাজার থেকে হেঁটে চলে এলাম কবির বাড়িতে। রাহমান বাই দরজা খুলে ছফা ভাই ও আমাকে অভিবাদন জানালেন। এই প্রথম আমি কবিকে দেখলাম। পত্রিকায় মৈনাক ছদ্মনামে তার কলাম পড়ি। কবিতার বই ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে।’ ইতোমধ্যে পড়ে ফেলেছি। ঈদ সংখ্যা সচিত্র সন্ধানীতে একটি ব্লেড ও সে’ গল্পটি পড়েছি। মাথাভর্তি একঝাঁক চুল, গোলগাল চেহারার সুদর্শন পুরুষ, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, কবি শামসুর রাহমান আমার সামনে বসে আছেন। আমি আমার প্রিয় কবিকে বিমুগ্ধ হয়ে দেখছি। ছফা ভাই চমৎকার একটা ভূমিকা দিয়ে আমাকে কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যখন শুনলেন আমি ইংরেজী বিভাগের ছাত্র, একটু নড়েচড়ে বসলেন। সেই আমার প্রথম পরিচয় সেদিন ভাবি মেঝেতে বসে চাল বাছছিলেন। এক মাথা লম্বা চুল। সুন্দর লাবণ্যময়ী এক নারী। আজকের মতো ববকাট চুল ছিল না সেদিন কবিপতœীর একটু লাজুক হেসে বিনম্র ভঙ্গিতে তিনি রান্নাঘরে আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি করতে চলে গেলেন। সেই, আমার প্রথম দেখা, সেই আমার প্রথম পরিচয়। এরপর প্রায়ই রাতে ল্যান্ড টেলিফোনে কথা হতো, কবিতা নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, আমাদের দেশের কিংবা বাইরের দেশের কবি ও কবিতা নিয়ে কবিতার বিভিন্ন আন্দোলন ও প্রবণতা নিয়ে অন্তহীন সংলাপ বিনিময় হতো। তখন আজকের মতো সেলফোন ছিল না ল্যান্ডফোনই ছিল একমাত্র নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের বাহন। কবিকে ছফা ভাই দেবতা কিংবা দেবদা বলে সম্বোধন করতেন। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ঠিকঠাক মনে করতে পারছি না। তবে ছফা ভাইয়ের সঙ্গে কবির ইনফর্মাল এবং খুবই আন্তরিক একটা সম্পর্ক ছিল। কবি টিএস, এলিয়টের ‘ইউজেস অব পোয়েট্রি এবং পেংগুইন বুক অব ইন্টারডিউজ বই দুটো পড়তে চেয়েছিলেন আমার কাছে। আমি তার অফিসে পৌঁছে দিয়েছিলাম। প্রায়ই আমাদের মাঝে বই আদান-প্রদান হতো। বনানীর নিজ বাসায় যখন তিনি স্থায়ী হলেন, তখনও যোগাযোগ অব্যাহত ছিল আমার সঙ্গে। বিভিন্ন এবং বিচিত্রসব শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ হতো। ভেবেছি সে সব অকথিত ও অপ্রকাশিত কথাগুলো বিস্তৃত লিখব। উপকৃত হবে শুধু এই প্রজন্ম নয়, শুধু কবিতাপ্রেমী মানুষেরা নয়, সাধারণ পাঠকও।
×