ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

বাংলার পটুয়া

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

বাংলার পটুয়া

বাংলার সংস্কৃতি ও চারুশিল্পের অঙ্কুর পুষ্পরূপে বিকশিত হয়েছে যাদের পরিচর্যায় তাতে শিল্পাচার্যের পরেই যে নামটি অকপটে আসে তিনি হলেন শিল্পী কামরুল হাসান। বাংলার ঐতিহ্য একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবন পটচিত্রের প্রতি আসক্তি এবং শ্রোদ্ধাবোধ থেকেই হয়ত। শিল্প জগতসহ সারা বিশ্বে নিজেকে পটুয়া শিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। পটচিত্র রচনার পাশাপাশি জলরং তেলরং, খোদাই, নির্মাণ, পোস্টার রূপকার, নক্সাকার বিভিন্ন মাধ্যমসমেত অবিচল সুষমা সমাহত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রেমে। রং, রেখা, গতিশীলতা, গভীরতা মাত্রা পেয়েছিল তার শিল্প সুর বন্ধনে। লোক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য ধারা সঞ্চালনের শক্ত গাঁথুনির সবটুকু সুগন্ধ আচ্ছাদিত করে আছে যেন তার প্রতিটি শিল্প পটকে। লোক জীবনের গভীর সারল্য সজীবতা সুবদ্ধ সুরের মনমুগ্ধকর প্রতিটি তান যেন ভেসে বেড়ায় কামরুল হাসানের চিত্রে বার বার তিনি গেঁথে গেছেন বাংলার লোকজীবনের শ্বাশত সংস্কৃতির শিকড়ের মালা। গ্রাম্য পরিবেশকে আধুনিকতার আঙ্গিকে আঁচ দিয়ে করেছেন নিখাদ খাঁটি। রেখাকে অধিক প্রাধান্য দিলেও সমপরিমাণ গুরুত্ব পেয়েছে উজ্জ্বল রংগুলোও। সাযুজ্যপূর্ণ রেখাবন্দী ফ্রেমে রঙের সংযোগে চিত্রকে আত্মার উপস্থিতির উপলব্ধির আসনে নিয়ে গেছেন এই প্রতিভাবান শিল্পী। কম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি তার তুলি থেকে। লোকজীবনের মর্মমূলে গাঁথা অনুরাগ ঐতিহ্যের বিন্দুতে মিশে সিন্ধুতে পূর্ণতা পেয়েছে তার হাতের স্পর্শে। পুতুলের ফর্ম শখের হাঁড়ি, পাখি, মাছ, প্যাঁচা, গাছ, শকুন, কুমির পাশাপাশি নিরীহ প্রাণী গরু, মোরগ, বিড়াল বক, ময়ূর কোন কিছুরই পরিত্রাণ মেলেনি তার শিল্প আঁচড় থেকে। লোকজ মটিভ অর্থাৎ ফর্মের সরলীকরণ এবং কিউবিজমের বিভাজনের একত্রীকরণের যে অত্যাশ্চর্য সুষমা তার দৃশ্যপট কামরুল হাসান ছাড়া সম্ভবপর নয়। লোক সংস্কৃতি যে কোন শিল্পের ভিত্তি আর তা মাথায় রেখেই শিল্প রচনায় একাগ্র ছিলেন এই ব্রতচারী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত শিল্পী। চিত্রে মৌলিক রং লাল, হলুদ, নীল, অনুষঙ্গে প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার অপার চিন্তা শক্তি ও গবেষণাধর্মী মনোভাবের। হলুদের প্রতি যদিও দুর্বলতার প্রকাশ দৃশ্যায়িত হয়েছে তথাপি একাঘেয়েমি মুক্ত পরিবেশ তৈরিতেই স্বার্থকতা লাভ করেছেন। হলুদের মধ্যে যে আনন্দ উচ্ছ্বাস এবং জীবনের গূঢ় তাগিদ নিমজ্জিত তারই চমৎকার প্রতিবেশ ও পারিপার্শ্বিক প্রগাঢ় প্রকাশ ঘটিয়েছেন যাতে যুক্ত হয়েছিল সার্বজনীনতা। তার প্রথম দিকের কাজে নারীদেহ অতি নিখুঁত ও নিয়মনিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। রমণীর প্রতিকৃতি সবটাইতেই রং প্রচেষ্টা দেখা যায়। পরবর্তীতে পঞ্চাশের দশকে এসে ফর্মকে টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন আধা জ্যামিতিক ভাঁজে সাজিয়েছেন। গ্রাম বাংলার আদি ঐতিহ্য আলপনার নকশা পদ্ধতিকে ঋদ্ধি দিয়েছেন অসীম একক মূর্ছনায়। চিত্রের বিষয়ের স্বতঃস্ফূর্ততাকে বিপন্ন না করে শৈল্পিক শাসন চালিয়েছেন অবিরাম ধারায়। প্রকৃতিবাদী সৌন্দর্যের উপাসক কামরুল হাসানকে আচ্ছন্ন করেছিল বাংলার পল্লীবালার সৌন্দর্য রূপলাবণ্য সঙ্গে পল্লবায়িত সজীব শুভ্র সতেজ প্রকৃতি। তাই আমৃত্যু প্রাকৃতিক রূপ, রস, বর্ণ অনুসন্ধান করেছেন তার চিত্র রচনার মধ্য দিয়ে। তিনি বাংলার গ্রামকে দেখে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে এই প্রকৃতির সৌন্দর্যের স্তুতি গান গেয়েছেন সর্বদাই। কলস কাখে গায়ের বধূ, স্নানরতা পল্লী তরুণী, তরঙ্গায়িত শান্ত নদী, দোদুল্যমান ধান, ভাসমান মেঘমালা, নৌকা, বৃক্ষ, লতা অবহেলিত জঙলি ফুল সুবিস্তৃত শ্যামল ভূমি, গৃহপালিত পশু প্রভৃতির সুর ব্যঞ্জনায় মুখরিত হয়েছে তার পল্লী সঙ্গীতের আবির মাখা ক্যানভাস। তেল রং, জল রং, টেম্পেরা কখনও বা ছাপচিত্রের আশ্রয়েও ফুটিয়ে তুলেছেন নানা সুরের পল্লী গুঞ্জন। জসীমউদদীন যেমন পল্লীর কবি, মাটির কবি বাংলার আত্মিক শেকড়ের কবি কামরুল হাসানও পল্লীরূপের অনুরূপ রূপকার। গ্রামের অনাড়ম্বর জীবনের দৈনন্দিন ঘটনাও তুলে এনেছেন অপার মহিমায়। আনকোরা, অমার্জিত, অদক্ষতা গ্রাম্য-সরলতা সহজ সাবলীল আবার প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণœ রেখেই লোকশিল্প নির্মিত হয় আর তারই অনুপ্রেরণায় আধুনিকতার ছাঁচে পরিমার্জিত এবং সুশীল রূপে নতুনত্ব দান সংযোগে রচিত তার শিল্পরচনা। এর সঙ্গে আরও সংশ্রিমণ ঘটান পিকাসোর ভগ্ন ফর্ম এবং মাতিসের উজ্জ্বল রং রেখার মাধুর্যপূর্ণ উপাদানের। বিষয়, চিন্তা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীকধর্মিতা দর্শনপূর্ণ উপস্থাপন নিমেষেই পরিসরকে ম্লান করে, যার বিন্দুসম উপস্থাপন শিল্পীর কাজে পরিলক্ষিত হয়নি কখনও। কৃষ্ণকলী তন্বী বিথী অপার সুসমায় রূপ লাবণ্যের ঘোমটা মুড়ি দিয়ে উঁকি মেরেছে কামরুল হাসানের ক্যানভাসের বাতায়নে। কখনও বা পল্লীবালার নায়র যাবার আনন্দ অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে কখনও আবার বধূর প্রিয়জনের অপেক্ষার পথপানে দৃষ্টি নিগূঢ়তাকে উপস্থাপন করেছেন। হাড় জিরজিরে অনাহারী মানুষের ছাপাই কাজের পাশাপাশি সুডৌল লাজুক গ্রাম্য তরুণীর জল রং সচ্ছলতায় দৃশ্যায়িত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদাতা হয়েও সৃষ্টি করেছেন বহু মহান কীর্তি। কমার্শিয়াল এবং আমলাতান্ত্রিক মন্থরতাকে সঞ্চালন করেছেন এই গুণী শিল্পী। ঘাতকের নারকীয় বীভৎসতার দানবীয় রূপ উপত্থাপন করেছেন। ইয়াহিয়া খানের প্রতিকৃতিতে তার অভ্যন্তরীণ পিশাচবৃত্তিকে প্রতিফলিত করেছে অমর সৃষ্টি ‘এই সব জানোয়ারকে হত্যা করতে হবে’ শীর্ষক পোস্টার চিত্রের দ্বারা। যুদ্ধের নিহত কঙ্কালসার দেহ ভূলুণ্ঠিত শহীদ সাধারণের ক্ষত-বিক্ষত অবয়ব ক্ষণিকের জন্য হলেও শিউরে দেয় দর্শকের আবেশ আচ্ছাদিত ইন্দ্রিয়কে। এরই ধারাবাহিকতায় নির্মাণ করে আরেক অক্ষয় কীর্তি ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ শীর্ষক অপর পোস্টার চিত্র। এতে পিকাসোর গোয়ার্নিকার রেশ রয়ে গেলেও তা স্বকীয় হয়ে আলোড়িত করে বাঙালীর চেতনাকে। তার চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় নারী অবয়বের প্রাধান্য। বধূ, জননী, তরুণী, বহুরূপী রমণীর অর্থাৎ মমতাময়ী অনুপ্রেরণাদাত্রী মা জাতিকে উপস্থাপন করেছেন আঙ্গিকগত ভিন্নতায়। পল্লীর পুকুরে স্নানরতা রমণীর মাঝেও যে প্রকৃতির মোহাচ্ছন্ন সৌন্দর্য অন্তর্নিহিত তা কামরুল হাসানের চোখ দিয়ে দর্শক দেখেছেন। তিনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা রচনায় এক আত্ম পরিচয় বিকশিত রাষ্ট্রের নক্সাকার হয়েছেন এবং বাংলাদেশের সরকারী প্রতীকেরও নকশা নির্মাণের কর্তা ছিলেন। তিনি অসংখ্য স্কেচ তৈরি করেছেন যার গুটিকয়েকের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বিভিন্ন স্থানে, মিউজিয়ামে, নিজস্ব সংগ্রহশালায়। স্কেচ রচনায় ক্যানভাস হয়েছিল খেরো খাতা, সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরের অংশ টুকরো কাগজ, কখনও বা দিয়াশলাই বক্সের ভেতর জমিন। যেগুলোর পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তি ঘটেছে অনেক আগেই। গরুর মুখের আদল নিয়েও নিরীক্ষা করেছেন প্রচুর যার প্রমাণ মেলে একচ্ছত্র বলিষ্ঠ এবং নিয়ন্ত্রিত রেখায়। নারী অবয়ব সাদৃশ্য গুল্ম লতিকার বঙ্কিমভঙ্গির একত্রিত উপস্থাপন দেখা যায় তার কাজে। প্রেমময়ী রমণীর চঞ্চলা নয়নের প্রকাশিত ভঙ্গি ফুটে উঠেছে তার ক্যানভাসে। কামরুলের কাব্যিক ও গতিময় লাইনের ছন্দোবদ্ধ প্রস্ফুটিত বিচরণ ছিল শিল্পের আঙ্গিনায়। বাঙালী সংস্কৃতির নান্দনিক রূপ সংরবরণে তার লব্ধ জ্ঞানের সর্বাত্মক প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার চিত্র অসীমতায়। অস্থির অনিন্দ্য কৃষকের বিমুখী ভূমি থেকে ফসল উত্তোলনের সংগ্রামী চেতনা ধারণ করেই নির্মাণ করেছেন বাঙালী সংস্কৃতির শিল্প কাঠামো।
×