ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা ফারুক

তার কবিতা যেন জল রঙের ছবি

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

তার কবিতা যেন জল রঙের ছবি

১০ ডিসেম্বর কবি বুলান্দ জাভীরের জন্মদিনে তাকে রাশি রাশি কবিতার উজ্জ্বল তোরণ ফোটা অভিবাদন। একজন পরিপূর্ণ কবি যে বুলান্দ জাভীর ইতোমধ্যে হয়ে উঠেছেন- তার সপক্ষে অজস্র পাতা ঝরিয়েছে ওই দেবদারু, মেহগনি, মেঘ শিরিষ আর ইউক্যালিপটাস। কত যে দুপুর বৃষ্টিতে গেছে ভেসে কবিতার শব্দের লিরিকে লিরিকে। কত যে বিকেল জেগে আছে গোধূলির আরক্ত ছায়ায়। ভোরের কুয়াশা ডোবা রানওয়ে থেকে কত যে বুনো খয়েরি শালিক গ্যাছে উড়ে দূরে দূরারণ্যে- শুধু কবিতার পালক গুঁজে বুকের বাদামী রোঁয়ায়। বুলান্দ জাভীরের কবিতা শুধু কবিতাই নয়। বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্তের জলরং ছবি যেন একেকটা, আর তাই অনস্বীকার্য রূপেই ভোরের মিহিন রোদের অফুরন্ত গুঞ্জরণে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে কবিতার ক্রিসেন্থিমাম। কাব্যগাঁথায় গ্রন্থিত হয় সাহিত্যের থোকা থোকা শব্দগুচ্ছ। থেকে থেকে যেমন প্রকৃতির আদলটা বদলে যায়। একইভাবে ঋতু বিবর্তনের স্পর্শে কবি-আর লেখকের মর্মেও দুলে ওঠে সৃষ্টিশীল তার ফুরফুরে কাগজের নৌকোটাও। তার কবিতা বিগত সাড়ে তিন দশক ধরে তাকে ধীরে ধীরে এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রচনার সুযোগ যেমন করে দিয়েছে একইভাবে একজন পরিশীলিত কবিতাকর্মী হয়ে ওঠার মেঘলা পথেও জ্বেলে দিয়েছে নিরন্তর পেট্রোম্যাক্স। আর তারই আলোকে আমরা বুলান্দ জাভীরের কাছ থেকে পেয়ে যাই সাত-সাতটি কাব্যগ্রন্থ। যথা : ‘টুলবেঞ্চি সময়ের জুঁই, কোথা তুমি ঘনশ্যাম, অন্তরে নির্বাক বহ্নি, তৃষ্ণা আমার বক্ষজুড়ে, অবচেতনায় মুক্ত তুমি, ভালবাসা একটি লাজুক ট্রেন এবং তবু বিহঙ্গ বন্ধ কর না পাখা।’ কবি বুলান্দ জাভীরের উল্লিখিত কাব্যগ্রন্থসমূহের কবিতার ভেতর যে লাল ঝাউবন দুলে ওঠে। আর ওই লাল ঝাউবনের গহনে যে কবিতার লাল, নীল, হলুদ রঙের পরীরা রূপকথার গল্পকে অমরত্ব দান করে। এ সবই কবি বুলান্দ জাভীরের কাব্যময়তার গভীর স্ফুরণ। পিয়ানোর ঝঙ্কারের মতো স্পন্দিত হয় কবির হৃদস্পন্দন। আর অন্তরের ঝাপ্সা বন্দরে ভিড়ে এসে দূরাগত কুয়াশা ভারানত নিঝুম স্টিমার। দিগন্তের জংশনে যখন এসে থামে কবিতা বোঝাই লেট্ ট্রেন। তখন ওই ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের ভেন্টিলেটর থেকে সাই করে দূরে উড়াল দ্যায় ফেব্রিকের মতো নরোম খয়েরি ফারকোট পরা চঞ্চল শালিক জুটি। ফুটি ফুটি করেও ফোটেনা ভোরের অলস রোদ। আর ওই রৌদ্রের বাস্কেট ভরে ওঠে মাইনাস জিরো আওয়ারের অনুষ্ণ সাইবেরিয়ান কনকনে হাওয়ার কুচি। গগনে মেঘার্ত বিকেল নিভে আসার আগে এক ঝলক ঝিলিকে গিয়েই মিলিয়ে যাবে সন্ধ্যা তারার বনে। অরণ্যে তখন শীতার্ত সম্বরের মিহিন পদশব্দে জেগে উঠবে ঝরা শিশির ভেজাপাতা আর বনমোরগের লাল ঝুটির মুকুটে নড়েচড়ে বসবে ইস্পাত নীল জ্যোৎ¯œার গুঁড়ো। ফরেস্ট বাংলোর গহন পোর্টিকোতে কয়েক পশ্লা দেবদারুর ছায়াবসে মেতে উঠবে সান্ধ্য কফির আড্ডায়। আর অদূরে চন্দ্রাতপ পর্বত রাজির পাদদেশে গহীনে নেমে আসবে ধু ধু ভয়ার্ত আবেশ। শীতের শীর্ণ নদী পেরিয়ে গিয়ে মিলিয়ে যাবে ভীতিকর শীতের মধ্যরাত। পাহাড়ের চূড়োয় মহুয়ার ডালে বসে থেকে থেকে ডেকে উঠবে রাত জাগা নিশুতি হরিয়াল। অরণ্য এমনই এক আবহে আবৃত হয়ে থাকে। আর ডাকে কবিতার পঙ্ক্তি গুচ্ছে, ডাকে ধুলোডোবা মন। আসে কবিতা জুরি গাড়ি করে। বাদামী ঘোড়ার কেশরের মতো আসে চরাচরে কবিতার তুমুল হাওয়া। কবিতা চিত্রকলায়Ñকখনও জলরঙে, তেলরঙেও আসে অবিশ্রাম। এ্যাব্স্ট্রাক্ট ছবির- মতো। এসে নিজেই যেন একপ্রস্ত ব্রাশের টানে বোগেনভিলিয়ার মতো ফুটে ওঠে মফস্বল শহরের কোনো শীতকাতুরে কিশোরীর উলের কার্ডিগানে বুলান্দের কবিতার ইশতেহার। তখন রোঁয়া ঝরা সকালগুলো ভীষণ স্মার্ট লাগে। লাগে যেন নিদারুণ ধোপ্দুরস্ত। যেন পেভমেন্ট ধরে কোট, টাই, প্যান্ট পরে সামনে কিছুটা ঝুঁকে এদিকেই আসছে কবিতারই এক তরুণ পথতরু। আর সারাদিন ধরে ধুলোডোবা আইল্যান্ডের শেডে বসে এক সুনসান তারা গাইছে গুন-গুন চন্দ্রহারা গান। আর কলতানহীন ধূসর জাম্পার পরা বিকেলগুলো ভেসে যায় বজরার মতো। মাঠে মাঠে ফোটে শিশির কণার মতো শীতফুল- জোটে কুয়াশার মতো জমাট কিশোরের দল লাটিম আর হিম্ঠা-া মার্বেলে! এমনই চিত্রকল্পের, উৎপ্রেক্ষার কনসেপ্ট ফোটে কবি বুলান্দ জাভীরের কবিতার নির্জন নার্সারিতে। তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ যখন হয়ে ওঠে ঋতু- প্রকৃতি। তখন স্বভাবতই এক নিঃসঙ্গ পাখির ছায়ার ভেতর শিশিরের, কুয়াশার, মিহিবৃষ্টির রেণুর অনুযোজনা ঘটে। তার কবিতায় ঝাপ্সা শীত আসে নেমে, আসে রেশমী শরৎ। রঙিন হেমন্ত যেমন এসে বসে ব্রাউন কালারের গাঙ্শালিকের মতো। তেমনি হলুদ বসন্তও এসে যায় দখিনা হাওয়ায় ভেসে ভেসে মর্মরিত ফিউশন জাগা এ্যাপ্লিকের কারুকাজ করা নিবিড় দিনান্তে। কবি বুলান্দ জাভীর আমাদের সময়ের এক উজ্জ্বলতম কবি। তার জন্মদিনে তাকে অফুরন্ত অভিনন্দন।
×