ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সোহরাব পাশা

পূর্বরাগ পূর্বস্বর ॥ নিকট অবলোকন

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

পূর্বরাগ পূর্বস্বর ॥ নিকট অবলোকন

কবিতাকে নান্দনিক শিল্প বলা যায়। রঙিন কাগজের ফুলে কোন ঘ্রাণ নেই। যদিও তা ফুলেরই প্রতিকৃতি। প্রকৃত কবিতায় ঘ্রাণ থাকে, যা কবিতার প্রাণরস বা কাব্যরস। কবিতার মূল অনুষঙ্গ হচ্ছে মানুষ, সংস্কৃতি, দেশ, প্রকৃতি ও সময়ের নির্যাস। এতে যুক্ত হয় কবির শিল্পিত মনন ও দার্শনিক প্রজ্ঞা। কবিকে চেনা যায় তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা দ্বারা। সময়-পরিবর্তনের সঙ্গে ভাষাও বদলে যায়। লেখককে সব সময় ভাষার সমান বয়সী হতে হয়। মনের সংযোগ রাখতে হয় ভাষার ব্যবহার, প্রকরণ ও ছন্দের প্রতি। কবির লেখার স্বাধীনতা আছে যেমন ইচ্ছে তার। তবে ফুল ছুড়ে দেয়ার নামে শুধু কাঁটা ছুড়ে দেয়ার দায়ভার এড়াতে পারেন না কবি। কারণ কবি সমাজবিচ্ছিন্ন কেউ নন। তিনি সমাজের একজন প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি। এসব বিবেচনায় কবি আশিক সালাম তাঁর ‘পূর্বরাগ পূর্বস্বর’ কাব্যগ্রন্থে সফলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। কবি আশিক সালাম সময়ের খ্যাতিমান প্রতিনিধি। তাঁর এই প্রতিনিধিত্ব ভাষা ও ছন্দের ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। কবি আশিক সালাম কাব্যাঙ্গনে পা রেখেই তাঁকে চেনার মতো নিজস্ব শৈলী (ংঃুষব) তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। কবি আশিক সালামের কাব্যগ্রন্থের ‘সামান্য আকাশ’ দেখার আগে কবির অসামান্য কৈফিয়তের পাঠ নিতে হয়। তিনি লিখেছেন, ‘বর্তমান বর্ধিত সংস্করণে গ্রন্থভুক্ত কবিতা দুটি পর্বে বিন্যস্ত হলো। ২য় পর্বের হন্তারক কালবেলা, পূর্ণিমার বিধ্বস্ত আকাশ, অলিভপাতার শোক এই তিনটি ছাড়া বাকি ১৪টি এবং ১ম পর্বের বাংলাদেশ : কম্পোজিশন-৫ মোট ১৫টি কবিতা নতুন করে নিবেশিত হলো। কয়েকটি কবিতা অল্পবিস্তর পরিমার্জনা পেল। নষ্ট মেয়ে শীর্ষক পদ্যটি প্রত্যাহৃত হলো।’ তাঁর এই কৈফিয়তের মধ্যে দিয়ে কেবল গ্রন্থভুক্ত কবিতার বিন্যাস-বৈশিষ্ট্যই আলোচিত হয়নি, আলো পড়েছে, কবি যে তাঁর কবিতার নিজেই যোগ্য শিক্ষক তার ওপর। গ্রন্থের শুরুতেই অভিবাদন জানিয়েছেন, ‘দেশ কাল ভাষা কৃষ্টি ধর্ম জাতি বর্ণ গোত্র শ্রেণি দল সম্প্রদায় লিঙ্গভেদ-নির্বিশেষে নিখিল মানবসত্তাকে আমার বিনম্র অভিবাদন : সু প্র ভা ত!’ (অভিবাদন) কবির এই অভিবাদন থেকে কবিতার পাঠকশ্রেণিকেও যুক্ত করেছেন। কারণ পাঠক-শ্রোতাও যে-কোন শ্রেণি-গোত্রভুক্ত। ‘চলিশ বসন্ত যায়’ শীর্ষক বিরামচিহ্নহীন টানাগদ্যে লেখা কবিতার শেষাংশ উদ্ধার করি ‘আলোকে-আঁধারে যাপিত জীবনব্যাপী বোধের মার্বেল গড়াতে গড়াতে যায় মাছরাঙাজলে ফলে দালির ঘড়ির ডায়ালে ক্ষরণ বিগলিত ক্ষণ অবিরল মোমের মতোন বহে নিরঞ্জন চলিশ বসন্ত যায় বসন্ত আসে না বসন্ত আসে না বসন্ত আসে না হায় জোছনার খয়েরি ছায়ায় নিসর্গের নীল ডালে হলুদ পাতায়...’/। জীবনকে সময় শাসন করে। জীবনকে পেছনে ফেলে সময় এগিয়ে যায়। জীবনের ভাঙচুর হয়, কিন্তু সময় নির্বিকার। বসন্ত কেবলই যায়, ফিরে আসে না। জীবনবোধের এই কবিতায় কবি আশিক সালামের মনস্তাত্ত্বিক চেতনার পরিচয় মেলে। গভীর দার্শনিক বিন্যাসে অনুপম তাঁর ‘ছায়ার প্রতিভা’ কবিতাটি। কবিতাটি ‘রিভার্স’ করে ছাপা হয়েছে। এতে আছে ছন্দের ভাঙচুর করা চমৎকার নকশা। যেমন, ‘আমি ছায়াকে ভেংচাই, ছায়া আমাকে ভেংচায়/ছায়ার ম্যাজিক বড়ো অমোঘ বাস্তব/ যাবতীয় অন্তেবাসী ছায়ার এ্যানিমেশন/অনাদিকালের ট্যাবুÑঘোর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন/ (অস্তিত্বের ভাঁজে ভাঁজে সাপের চক্করঅলা পাপের নিকেল)/যেখানেই যাইÑ যেই দেশে যাইÑযত দূরে যাই দৌড়াতে দৌড়াতে/ (হা কপাল!) যমের দোসর ছায়া-সে আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে/ইরেজারে চাই মুছে দিতে ছায়ার ১ কার্বনলিপি : সংকলিত/ দাহ/ ক্ষোভ/ ভস্ম/ ক্লেদ/ ধুলো/ স্মৃতি/ লাভাÑ/হেসে ওঠে ছায়ার প্রতিভা’/। কবি আশিক সালাম ‘ছায়ার প্রতিভা’র মধ্যদিয়ে জীবন, জীবনের পরিণাম, সমাজ, সংসার, প্রকৃতি ও নিয়তির সঙ্গে গভীর-নিবিড় সম্পৃক্ততার সন্নিহিত অদৃশ্য ছবিকে দৃশ্যমান করে তুলেছেন অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্যে। একসময় গ্রামবাংলার মানুষ ধন্বন্তরিজ্ঞানে ভেষজ-চিকিৎসার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। সেই বিশ্বাসের মূলে ছিল ঐতিহ্যের শেকড়। আধুনিকতার দুর্মর প্রতাপে সংস্কৃতির এই ছিন্নসূত্রতাই উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর ‘হাতিশুঁড়া’ কবিতায় : ‘কাস্তেহাতে অঘ্রাণের ক্ষেতে ধান কাটতে গিয়ে/হাতের আঙুল কেটে আসেন আব্বা/মনে পড়ে আব্বার কর্তিত আঙুলের লোহু/আর আম্মার শুশ্রƒষা হাতিশুঁড়া গুল্মের নির্যাস’/ (হাতিশুঁড়া)। কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘মানুষ মাত্রেই অমৃতের পুত্র’; চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই’। শুধু বৈষ্ণব বা সুফিবাদেই নয়, সকল ধর্মেই মানুষের মহিমার গুণকীর্তন করা হয়েছে। কবি আশিক সালামের ‘সাবজেক্ট-ম্যাটার’ কবিতাতেও মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বিধৃত হয়েছে। কেবল ধর্ম বা কোন মতবাদে নয়, সকল শিল্পমাধ্যমেই ‘মানুষ’ অশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। কবি বলেছেন, ‘বিষয় বলতে একটি মানুষ/ বিষয় বলতে মানুষরতন/বিষয় বলতে মানুষজাতক/ বিষয় বলতে অমৃতস্য...’/(সাবজেক্ট-ম্যাটার)। গ্রন্থভুক্ত ‘ধর্মাধর্ম’ এবং ‘ওরা ছয়জন’ কবিতাতেও মানুষের ধর্ম, আচরণ ও মানুষকে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করার বিষয়- আশয় বিধৃত হয়েছে। ‘ভাঙছে, ভাঙছে’ ৪২ লাইনের একটি দীর্ঘ কবিতা। এতে প্রতি দু’লাইনে অন্ত্যানুপ্রাস ব্যবহারে একধরনের দ্যোতনা তৈরি হয়েছে। ‘ভাঙছে, ভাঙছে’ কবিতার হাওয়া লেগেছে ‘হাওয়ায় হাওয়ায়’ কবিতায়। দুটি কবিতাতেই সবকিছুর অদল-বদল, পরিবর্তনের অনিবার্য যে-সত্য তার অন্তর্গত শব্দ-ধ্বনির আলো পড়েছে। তাঁর ‘নারী’ কবিতাটি বিষয় ও বিন্যাসে গুরুত্ব পেয়েছে। এতে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি, মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ব্যক্তি ও সমাজ-জীবনে নারীর অবস্থান উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন, ‘ওরা বলেÑহাসো, আমি হাসি/ওরা বলেÑকাঁদো, আমি কাঁদি/...আমি নারী/সর্বংসহা মৃত্তিকার ধুলো’/ (নারী)। ভাষা আন্দোলন, একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা আমাদের সাহিত্যকে আলোকিত করেছে। সমৃদ্ধ করেছে শিল্পমানসকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালীর আলোকিত বাতিঘর। অনালোকিত নিজস্ব পৃথিবী আলোকিত করেছে মুক্তিযুদ্ধ। গ্রন্থভুক্ত বেশক’টি কবিতা ওই চেতনাকে ধারণ করে বিবিধ ভঙ্গিতে বিকশিত হয়েছে। ‘সেইসব দিন এলে’, ‘দীর্ঘরাত্রির লালিত স্বপ্ন’, ‘আমাদের পতাকা ছিল না’, ‘পাথর-সভ্যতা’, ‘অসমাপ্ত কোরাস’, ‘বাংলাদেশ : কম্পোজিশন-১, ২, ৩, ৪, ৫’, ‘অলিভপাতার শোক’Ñ সেই রক্তাক্ত বেদনার স্মৃতিকেই বহন করে। ‘একটি ভাষা/একটি যুদ্ধ/দীর্ঘ নদী/দীর্ঘ সাঁতার/একটি পতাকা/একটি মানচিত্র/একটি গান/ অশেষ কবিতা’/ (বাংলাদেশ: কম্পোজিশন-২)। ‘পূর্বরাগ পূর্বস্বর’এর দ্বিতীয় পক্ষ বলা যায় কাব্যের ‘কৃষ্ণপক্ষ’ অংশকে। এ অংশের প্রথম কবিতার শিরোনাম ‘প্রতিবেদন : জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস’Ñ কবিতাটিতে রাষ্ট্রের কাছে জনগণের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা এবং প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার নকশা মূর্ত হয়েছে। ভাষা ও ছন্দের বর্ণিল চিত্ররূপ ‘স্বর্ণলতায় শিলাবৃষ্টি’ ও ‘খাইকুঁড় হাওয়া’ কবিতা দুটি। ‘নিরোর বাঁশি’, ‘গণতন্ত্র আসিতেছে’, ‘তিনি’, ‘কোকিল’, ‘চোরাবালি’, ‘আগুনখোর’ প্রভৃতি কবিতায় অধিকারবঞ্চিত মানুষের চিত্ররূপ ও গণতন্ত্রের নামে, সুশাসনের নামে শোষণের ‘কৃষ্ণপক্ষ’ অঙ্কিত হয়েছে। ২ কবি আশিক সালামের ‘পূর্বরাগ পূর্বস্বর’ কব্যগ্রন্থে কবির পরিশীলিত মেধা ও মননের পরিচয় মেলে। কবিতার বিষয় অনুসারে ভাষা ও ছন্দের ব্যবহার গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছে। আশিক সালাম ছন্দসচেতন কবি। তাই বিভিন্ন ছন্দের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন। চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন; এড়িয়ে চলেছেন কবিতার দুর্বোধ্যতাকে। গ্রন্থটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন আরিফুর রহমান। এর প্রথম প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৫, এবং দ্বিতীয় প্রকাশ (বর্ধিত সংস্করণ) ফেব্রুয়ারি ২০১৪, বেরিয়েছে টুম্পা প্রকাশনী থেকে। মূল্য মাত্র এক শ’ টাকা। ‘পূর্বরাগ পূর্বস্বর’এর বহুল প্রচার কামনা করি। পাঠক অবশ্যই ভাল বইটি খুঁজে নেবেন।
×