ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জাভেদ হাকিম

ঝর্ণার গান শুনতে সিকাম

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

ঝর্ণার গান শুনতে সিকাম

বর্তমান সময়ে তরুণ,যুবক বা প্রবীণ সব বয়সী ভ্রমণপিপাসুদের প্রথম পছন্দের জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম শিল্পীর তুলিতে আঁকা সাজেক ভ্যালি। কিন্তু অনেক ভ্রমণ প্রেমীই জানেন না যে, সাজেকের নিচেই রয়েছে ছোট-বড় তিনটি ঝর্ণা-ঝিরিপথ ও অসংখ্য ক্যাসকেড। গেল ঈদের ছুটিতে সাকা হাফং যেতে না পেরে তৈসার দিকে ছুটি। রাতের গাড়িতে চড়ে সকালে গিয়ে নামি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা। সেদিন দীঘিনালার তোজেংমাসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। পরদিন সকালে যাব রাঙ্গামাটির সাজেক পর্যটন কেন্দ্র হয়ে তৈসা ঝর্ণা। ফোন দেই চান্দের গাড়িওয়ালাকে। ড্রাইভার জানায় বস সাজেক রোডে ভূমি ধস। গাড়ি সব আটকা। কয়টা নাগাদ ঠিক হতে পারে জানতেই সে জানায়। সেনাবাহিনী কাজ করছে সময়ের নিশ্চয়তা নেই। ইয়া খোদা কি আর করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছইু করার নেই। তবে হাল ছাড়িনি। সকালের সময়টা কাজে লাগাতে চলে যাই বোয়ালখালী ইউনিয়নের হাজাছড়া ঝর্ণার প্রান্তরে। মেইন রোড হতে মাত্র বিশ মিনিটের হাঁটার পথ। ঝিরিপথ পেরিয়ে হাজাছড়া ঝর্ণা দেখেই বেশ ভাল লাগে। গত রাতে বৃষ্টি হওয়ায় ঝর্ণার যৌবনও বেশ। প্রায় ৮৫-৯০ ফিট ওপর থেকে রিনী ঝিনী শব্দ তুলে ঝড়ে শীতল পানি। আশপাশের গাছগুলো এমনভাবে রয়েছে যেন এই পড়বে মাথার ওপর। এক কথায় অসাধারণ মুহূর্ত। পাহাড়ী উঁচু-নিচু প্যাঁচানো পথে যখন বাইক ছুটে চলেছে তখন মনে হয়েছে যেন আমরা রোলার কোস্টারে করে ছুটে চলেছি সবুজের কার্পেট মাড়িয়ে নীল দিগন্তের রাজ্যে। সাজেক ঢোকার অল্প কিছু পথ আগেই সাতমাইল নামক জায়গা, সেখানেই ঘটেছিল ভূমিধস। সড়ক এখনও প্রায় বন্ধ। দু’-চাকার বাহন হওয়াতে, কোন রকমে অতিক্রম করে ভর সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছাই সাজেকের রুইলুইপাড়া। আগেভাগেই কটেজ বুকিং ছিল। ভতরে যেতেই চোখ ছানাবড়া, ওয়াও এ যেন শুভ্র মেঘের ঢেউয়ে পুরো কটেজ ভেসে চলেছে। সঙ্গে পূর্ণিমা রাত। সত্যিই এক অসাধারণ দৃশ্য। দ্রুত সাফ সতুর হয়ে চলে যাই সোজা হেলিপ্যাডে। আকাশে অসংখ্য তারার মেলা-সঙ্গে ভরা জোছনার আলো। যেন চান্দের বাতির যৌবন উথলে পড়ে। গান-কবিতা-আড্ডার সঙ্গে জোছনার আলো উপভোগ করে ফিরি রুইলুইপাড়া। শুরু হয় কয়লা-লাকড়ি-চুলা খোঁজা। অতঃপর অনেক রাত অবধি সুরের মূর্ছনায় চলে বার-বি-কিউ পার্টি। রাত প্রায় দুটো- যাই এবার ঘুমাই। মেঘের চাদরে ঘেরা কাঠের তৈরি কটেজে, কাঁথা মুড়া এক ঘুম দিয়ে পর দিন ফজর নামাজ পড়েই বাইক চালক দুলাল কবিরাজ ও স্থানীয় এক ত্রিপুরা গাইড নিয়ে আগাই তৈসার দিকে। হ্যাঁ, বন্ধুরা তৈসা এক বুনো সৌন্দর্যের পাথুরে ঝর্ণার নাম। সাজেকের আইকন রুন্ময় হতে একটু ডানে এগিয়ে স্কুলের পেছন দিকের জংলী পথ ধরে হাঁটতে থাকি। অল্প কিছু দূর যেতেই লতাগুল্ম দিয়ে ঘেরা একটি ক্যাসকেড হতে পানি পড়ার শব্দ পাই। এর পরের কাহিনী অন্য রকম। একেবারে আদিম জংলী পথে হাইকিং। কখনও আবার প্রায় ৮০-৮৫ ডিগ্রী খাড়া হয়ে নেমে যাওয়া পিচ্ছিল পথে ট্রেইল শেষে পেয়ে যাই পাথুরে ঝর্ণা তৈসা। আনন্দ উল্লাস শেষে যখন ফেরার পথ ধরব তখনই গাইড জানালো চলেন সামনে। দেখাইয়া নিয়া আসি সিকাম তৈসা ঝর্ণা। আরে বেটা বলিস কি? কই চল তাড়াতাড়ি। নব আনন্দচিত্তে, ঝিরি পথ ধরে কাত হয়ে থাকা বড় বড় গাছের ফাঁক গলে বিশাল বিশাল বোল্ডার মাড়িয়ে এগিয়ে যাই সিকামের দিকে। সম্ভাবত আধ ঘণ্টার মধ্যেই দেখা মিলে ইয়া উঁচু থেকে পানি পড়তে থাকা সিকাম তৈসা ঝর্ণা। দু-চারটা আছাড় খেয়ে যে ব্যথা পেয়েছিলাম তাও সিকামের সান্নিধ্যে এসে সব উধাও। ওয়াও ! ইচ্ছে হচ্ছিল দুচোখ দিয়ে গিলে খাই সব সৌন্দর্য। সিকাম তৈসা ঝর্ণার উচ্চতা প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ফুট হবে। এর পানি দু’ধাপে পড়ে। প্রথম ধাপ গড়িয়ে আর দ্বিতীয়টি বাসাবাড়িতে ফিট করা শাওয়ারের মতো। ঝর্ণাটির অবস্থান সিপ্পু পাহাড়ের পাদদেশে। প্রায় দুই হাজার ফিট নিচে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঝিম ঝিম শব্দ তুলে অবিরাম ধারায় আপন ছন্দে সিকামের পানি পড়ে। আশপাশের পুরো পরিবেশটাই বুনো গন্ধে মন মাতানো। অবাক বিস্ময়ের সিকাম তৈসা ঝর্ণাটি যেন নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মাখা লীলা খেলার প্রতিমা। যদি বেঁচে থাকি তাহলে কোন এক পূর্ণিমার রাতে তোমার রিম ঝিম গান শুনতে শুনতে চাদের বিলিয়ে দেয়া আলোর আলিঙ্গনেÑ ‘তাঁবু বাসে রাত কাটাব ইনশাআল্লাহ্। কি ভাবে যাবেন : ঢাকার গাবতলী-ফকিরাপুল-সায়েদাবাদ হতে দিনে রাতে প্রতিদিন খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালা বিভিন্ন পরিবহনের এসি/নন এসি বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫২০ থেকে ৫৮০ ও ৯০০ টাকা মাত্র। সিকাম তৈসা ঝর্ণার অবস্থান রাঙ্গামাটি জেলা হলেও খাগড়াছড়ি দিয়ে যাতায়াতের সুবিধা বেশি। খাগড়াছড়ি / দীঘিনালা / বাঘাইহাট হতে বাইক /জীপ/ মাহেন্দ্রতে চড়ে সাজেক ভ্যালির রুইলুইপাড়া। এরপর সাজেকের প্রাইমারী স্কুলের ডান পাশ দিয়ে ট্রেইল। আপনার সুবিধা অনুযায়ী যে কোন পরিবহন ভাড়া দর-দাম করে নেয়াই ভাল তবে ফেরার বিষয়টাও কনফার্ম করে নেবেন কারণ রিজার্ভ না নিলে গাড়ি পেতে ঝামেলা হয়। গাইড চার্জ ৪০০ টাকা। থাকা-খাওয়া : বর্তমানে সাজেকে প্রচুর কটেজ ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ভাড়া মাথাপিছু ২০০ টাকা হতে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সরকারী ছুটি ছাড়া অন্য দিনগুলোতে অগ্রিম বুকিং না দিলেও চলবে। খরচপাতি : দুই দিনের জন্য জন প্রতি ৪০০০ হাজার টাকা হলেই হবে তবে খরচ অনেকটা নিজেদের ওপরই নির্ভর করে।
×