ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এস এম মুকুল

সৌন্দর্যের রানী টাঙ্গুয়ার হাওড়

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

সৌন্দর্যের রানী টাঙ্গুয়ার হাওড়

বিশাল জলরাশির মাঝে করচ বা হিজল গাছ। জলের ওপর ভেসে থাকা ছোট ছোট দ্বীপের মতো বাড়ি। নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এসব মিলিয়ে টাঙ্গুয়া হাওড় তিলোত্তমা প্রকৃতির শোভায় সজ্জিত অপার দিগন্ত। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংরক্ষিত জলাভূমি (রামসারসাইট) ও জীববৈচিত্র্যের আধার এই টাঙ্গুয়ার হাওড়। এই জলাশয়টিকে জাতিসংঘের রামসার কর্তৃপক্ষ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে ২০০০ সালে স্বীকৃতি দিয়েছে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত একেক ঋতুতে এ হাওড়ের একেক রূপ। শীতকালে নীরব-নিস্তব্ধ বিশাল হাওড়ে পাখির কলকাকলি আর মাছের বুদবুদে হাওড়ের নীরবতা ভাঙ্গে। আবার বর্ষায় তলিয়ে যায় বিশাল হাওড়ের তীর ও তীরের জনপদ। হিজল-করচ ও নলখাগড়ার বুক অবধি হাওড়ের পানি ঢেউ খেলে। এখানে বর্ষায় আরেক বিচিত্র রূপ পরিস্ফুটিত হয়। মাছ ও পাখির অভয়ারণ্য টাঙ্গুয়ার হাওড় এখন এক অপার সম্ভাবনার নাম। টাঙ্গুয়ার হাওড় সিলেটের সুনামগঞ্জে অবস্থিত। এই জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের ঠিক নিচে অবস্থিত এই হাওড়। ছোটখাট ৫১টি হাওড়ের সমন্বয়ে ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওড় জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি এবং বাংলাদেশর ২য় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টি ঝরনা এসে মিশেছে এই হাওড়ে। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের অন্যতম আকর্ষণ বিভিন্ন জাতের পাখি। বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, শকুন, পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস ইত্যাদি পাখির নিয়মিত দেখা মিলে এই হাওড়ে। দেশের অন্যান্য হাওড়ের সঙ্গে টাঙ্গুয়ার ভিন্নতা হলো এর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ছোট বড় ৫১টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত এই হাওড়। পরিবেশবাদীদের গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে বিপন্ন প্রায় বিরল প্রজাতির ২ শতাধিক পাখির অভয়াশ্রম এই টাঙ্গুয়ার হাওড়। বিপন্ন ১৫০ প্রজাতির মাছের সমাগম এখানে। ভারতে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় থেকে নেমে আসা ২০ হাজার একরের ভূমি নিয়ে অন্যতম মিঠা পানির জলাভূমি এই টাঙ্গুয়া হাওড়। অববাহিকার সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক জলাভূমি হেমন্তে পানি শুকিয়ে এর আয়তন দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯ শত ১২ দশমিক ২০ একর। শুকনো মৌসুমে এখানকার সাড়ে ১৫ হাজার একর জমিতে বোরো ধান উৎপন্ন হয়। সুনামগঞ্জের বিশাল এই হাওড়টি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। অনেকেই এ হাওড়কে সম্পদ ও সৌন্দর্যের রানী হিসেবে অভিহিত করেছেন। সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শুকনো মৌসুমে স্পিডবোটে সেখানে যেতে সময় লাগে ৩-৪ ঘণ্টা। আর হেমন্তকালে মোটরসাইকেলে ৫-৬ ঘণ্টা। তবে বর্ষায় হাওড় পথে স্পিডবোটে সেখানে যেতে সময় লাগে দু’আড়াই ঘণ্টা। মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার অনগ্রসরতার কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায় বিশাল সম্ভাবনার এ অঞ্চলটি। টাঙ্গুয়ায় রয়েছে স্তন্যপায়ী দুর্লভ জলজপ্রাণী গাঙ্গেয় ডলফিন (শুশুক), খেঁকশিয়াল, উঁদ, বনরুই, গন্ধগোকুল, জংলি বিড়াল, মেছো বাঘ। গাছগাছরার মধ্যে রয়েছেÑ নলখাগড়া, হিজল, করচ, বরুণ, রেইনট্রি, পদ্ম, বুনো গোলাপসহ ২০০ প্রজাতিরও বেশি গাছগাছরা। যা থেকে জ্বালানি কাঠ, আসবাবপত্রসহ গৃহসামগ্রী ও সৌখিন শোপিস তৈরির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় হয়। চিতল, মহাশোল, সরপুঁটি, বাঘাইর ও রিটাসহ প্রায় ২৬ প্রজাতির বিপন্ন এবং ১৬ প্রজাতির অতিবিপন্ন মাছসহ প্রায় ১৪১ প্রজাতির মাছ রয়েছে। কুনোব্যাঙ, কোলাব্যাঙ, ঝিঁ ঝিঁ ব্যাঙ, কটকটি ব্যাঙসহ টাঙ্গুয়া হাওড়ে ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী দেখা যায়। সুন্ধি কাছিম, ঢোরা সাপ, টিকটিকি, অঞ্জনিসহ ৬ প্রজাতি কচ্ছপ, ৭ প্রজাতি টিকটিকি এবং ২১ প্রজাতি সাপ মিলিয়ে সরীসৃপ রয়েছে প্রায় ৩৪ প্রজাতির। টাঙ্গুয়া হাওড়কে রংবাহারি পাখির রাজ্য বললে অত্যুক্তি হবে না। লালঝুঁটি ভুতিহাঁস, লেঞ্জাহাঁস, চখাচখি, কালালেজ জৌরালী প্রভৃতি পরিযায়ী পাখিসহ প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখি দেখা যায় এ হাওড়ে। এদের মধ্যে প্রায় ৯৮ প্রজাতির পাখি শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে সবুজ সুইচোরা, শঙ্খচিল, দেশী মেটেহাঁস, পাতি সরালী, ছোট পানকৌড়ি, এশীয় শামুকখোলসহ প্রায় ১২১ প্রজাতি আমাদের দেশী পাখি। পাখির নিরাপদ আবাসস্থল ও খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ২টি বিলকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। এছাড়া দেশী মাছ সংরক্ষণের জন্য হাওড়ের ৪টি বিলকে মৎস্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। ঘুরে আসুন আপনিও : ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ শ্যামলী, ইউনিক ও এনা পরিবহনে। সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাহেববাজার ঘাট রিকশায়। সাহেববাজার থেকে টাঙ্গুয়ার হাওড়ের উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনচালিত নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে যেতে পারেন। আবার ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জগামী হাওর এক্সপ্রেসে মোহনগঞ্জ। মোহনগঞ্জ থেকে ধর্মপাশা হয়েও লঞ্চ, ট্রলার, মোটরসাইকেল বা স্পিডবোর্ডে টাঙ্গুয়ার হাওড় দেখতে যাওয়া যায়। # ঢাকা থেকে রাতে শ্যামলী আর এনা সরাসরি সুনামগঞ্জ ভাড়া সাড়ে ৫শ থেকে ৬শ। ভোর ৬টায় আব্দুজ জহুর সেতুর ওপর নেমে প্রতিজন ৭০-৮০ টাকা ভাড়ায় ট্যাক্সি/সিএনজি বা মোটরসাইকেলে সরাসরি তাহির পুর চলে যেতে পারবেন। তাহিরপুর থেকে একদিনের জন্য তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নৌকা ভাড়া করে নিজের সুবিধামত যে কোন সময়ের জন্য নিতে পারবেন। টেকেরঘাট এবং বারিক্কাটিলা হোটেলে খেতে পারবেন অথবা নিজেরা বাজার করে মাঝিকে দিলে সে তার বাড়িতে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। থাকা : বেসরকারীভাবে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে রাতে থাকার মতো হোটেল নেই। তবে তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউসে থাকা যায়। হাওড় ঘুরে রাতে তাহিরপুর থানার ডাকবাংলোতেও থাকা যাবে। দর্শনীয় টাঙ্গুয়ার হাওড় যা যা দেখবেন : টাঙ্গুয়ার হাওড়, বারেকের টিলা, টেকেরঘাট এবং বরছরা, যাদুকাটা নদী, অদৈত মহাপ্রভুর বাড়ি, চুনাপাথরের লেক। সুনামগঞ্জে যা যা দেখবেন : রিভারভিউ, হাছন রাজার বাড়ি এবং সমাধি, নারায়ণ তলা, ইন্ডিয়ার বর্ডার বাজার, শাহ আরেফিনের মাজার, গৈরারং জমিদার বাড়ি ও বাউল সম্রাট আবদুল করিমের বাড়ি।
×