ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ও লড়াকু নারীরা

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ও লড়াকু নারীরা

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অহঙ্কার। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের এ অর্জন। আর এ অর্জনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদানও কম নয়। কেননা পাকিস্তান ছিল সেই সময় অষ্টম সামরিক শক্তিপ্রধান দেশ। তার উপর ছিল আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশের প্রত্যক্ষ সমর্থন। তারপরেও আমরা বিজয়ী হয়েছি। মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছি লাল সবুজের পতাকা। আমাদের প্রিয় লাল সবুজ পতাকার পুরুষের রক্তের পাশাপাশি মিশে আছে নারীর রক্ত ও আত্মত্যাগ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছে। কিন্তু ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইটিং কমিটি তাদের বলছে, এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৬০ হাজার। এমনকি ৯ মাসে যে ৩০ লাখ বাঙালী গণহত্যার শিকার হয়েছে তার ২০ শতাংশই নারী। মুক্তিযুদ্ধে নারী-পুরুষের উভয়ের অংশগ্রহণ ছিল। আর উভয়ের অংশগ্রহণ ছিল বলে আমরা তা পেরেছি। নারীরা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কেউ অস্ত্র হাতে কেউ বা পৌঁছে দিয়েছে যোদ্ধাদের কাছে গোপন খবর, কাজ করেন চিকিৎসক হিসেবে, সেবিকা হিসেবে আবার রাধুনী হিসেবেও। তবে নারীরা যে পরিমাণ অবদান রেখেছেন সেই পরিমাণ সম্মান তারা পাননি। পায়নি বলেই তারামন বিবির মতো সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধাকে অপেক্ষা করতে হয়ে কয়েক যুগ। ১৯৯৫ সালের আগে সরকার, সমাজ ও রাজনৈতিক দল, এমনকি গবেষক, নারী আন্দোলনের সংগঠক কেউই খোঁজ করেননি তারামন বিবিকে। অধ্যাপক বিমল কান্তি দে সংবাদপত্রে তুলে ধরেন তারামন বিবির খবর একটি জাতীয় দৈনিকে ১৯৯৫ সালে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তারামন বিবিকে বীরপ্রতীক পদক হস্তান্তর করেন। বীরপ্রতীক হয়েছেন দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি ও ডাক্তার সেতারা বেগম। ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম ১৯৭২ সালেই বীরপ্রতীক সম্মানের পদক গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া ১৯৯৭ সালে দৈনিক সংবাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধির অনুসন্ধানে জানা যায় মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবির কথা। সুনামগঞ্জের সীমান্ত অঞ্চলের খাসিয়া পরিবারের সন্তান কাঁকন বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও অস্ত্র বহন করতেন। বিথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণা দুই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা গ্রেনেড চার্জ করে গানবোট উড়িয়ে দিয়েছিলেন, আলিয়া বেগম যুদ্ধ করেছিলেন পুরুষের পোশাক পরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিরিন বানু (মিতিল) পুরুষের বেশে পাবনায় প্রতিরোধ আন্দোলন করেছিলেন। সিলেটের বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা রুমা চক্রবর্তী দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। রাজশাহীর গর্ব বীর সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা সাবিত্রী বিশ্বাস। আগরতলায় অবস্থিত হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে। ছাত্রনেতা থেকে নারীনেত্রী মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানম। একাত্তরে উত্তাল দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্রনেতা মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন তাদেরই একজন আয়েশা খানম। পরে আগরতলায় গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। আজও নারীদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন সাহসের সঙ্গে। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী পাক সেনাদের হাতে নির্যাতিত হন। সম্প্রতি বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। আসলে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান ছিল বহুমাত্রিক, সব ধর্মের নারীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। কেবল বাঙালী নয়, সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আদিবাসী নারীরাও। কিন্তু দুঃখের বিষয় নিম্নবর্গ নারীর ইতিহাস ক্ষমতাশীল সুশীল সমাজের কাছে উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পরে। এখনও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ে গবেষণা পর্যায়ে খানিকটুকু কাজ হয়েছে। তবে আশার কথা এখনও বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। আবার অনেক নারী কোন স্বীকৃতি না পেয়েই মারা গেছেন অদৃশ্য হয়ে গেছে তাদের বীরত্ব। যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের এই দেশের অনেক নারী হারিয়েছেন তার নিজের পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ সদস্য যেমন বাবা, ভাই, স্বামী, ছেলে। পাকিস্তানী হানাদারদের বর্বরোচিত হামলায় কোন পুরুষ জীবিত না থাকায় আমাদের দেশের অনেক গ্রাম পরিচিত পেয়েছিল ‘বিধবার গ্রামে’। এমনকি অনেক নারী ধর্ষিত হওয়ার ফলে পরবর্তীত তাদের বিয়ে পর্যন্ত হয়নি, সংসার, সন্তান তাদের ভাগ্যে জোটেনি। পরিবারের বোঝা হয়ে অনাদর অবহেলা এরা সয়ে গেছেন নীরবে নিভৃতে। তাই অনেকে বলে থাকেন মুক্তিযুদ্ধে নারীরা হারিয়েছেন অনেক কিছু, ত্যাগও অনেক কিন্তু তাদের প্রাপ্তি সেই তুলনায় কম। হয় তো এখনও ভালভাবে অনুসন্ধান করলে তারামন বিবিদের মতো লড়াকু যোদ্ধা বের হয়ে আসতে পারে। সেই সময় দেশের অর্থনীতিতে অনেকাংশের হাল ধরেছিল এই মহান এবং সাহসী নারীরাই। সংসারের পুরো দায়িত্ব ছিল তাদেরই কাঁধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছেন অনেক নারী। নূরজাহান মুরশীদ, আতিয়া বাগমারের মতো উচ্চ শিক্ষিত নারীরা প্রবাসে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন, তহবিল সংগ্রহে কাজ করেছেন। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন ধাপে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন পরে হলেও বর্তমান সরকারের এটি একটি ভাল উদ্যোগ। কেননা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীদের ত্যাগের কথা উল্লেখ করেছিলেন ১৯৭০ সালের ৭ মার্চ ভাষণে। তিনি ঘোষণা দেন ‘আমি আগেই বলে দিয়েছি কোন গোলটেবিল বৈঠক হবে না, ...যারা আমার মা-বোনের কোল শূন্য করেছে, তাদের সঙ্গে বসব আমি গোলটেবিল বৈঠকে? যদি একটি গুলি চলে, তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান নারীসমাজকে আপ্লুত করেছিল। ফলে যে যার অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন সাবভৌম রাষ্ট্র পায়। এই বিজয়ের মাসে ৭১-এর সব বীর নারীকে জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন। পাশাপাশি বাংলার মায়েরা সকলেই বীর, করলেই মুক্তিযোদ্ধা। [email protected]
×