ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নূর কামরুন নাহার

ফিদেল ক্যাস্ট্রো এক অবিনাশী বিপ্লবী

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

ফিদেল ক্যাস্ট্রো এক অবিনাশী বিপ্লবী

আমার নাম ফিদেল ক্যাস্ট্রো, কিউবাকে মুক্ত করার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে। আত্ম বিশ্বাসের সঙ্গে এই উক্তি যিনি করেছিলেন তিনি আজন্ম বিল্পবী কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের জয়জয়কারের মধ্যেও পাঁচ দশক তা টিকিয়ে রেখে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। ২৫ নবেম্বর চলে গেলেন তিনি। জন্ম শৈশব ও কৈশোর ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে বিরান জেলায় স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক অভিবাসী পরিবারে জন্ম হয় তার। পুরো নাম ফিদেল আলেজান্দ্রো ক্যাস্ট্রো রুজ। বাবা ছিলেন আখের খামারী। মা ছিলেন ধার্মিক। অল্প বয়েস থেকেই পাহাড়ে ওঠা ছিল তার খুব পছন্দের। বৃষ্টি হলে যখন ফুঁসে উঠতো পাহাড়ী নদী সাঁতরে পার হতেন সে নদী তখন অন্য কিছু খেয়াল থাকতো না। ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে আনন্দ পেতেন। পড়াশোনায় হাতে খড়ি মায়ের কাছে। মা ধর্ম পড়াতেন। শিখিয়েছিলেন যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ। মার কাছে এই অঙ্ক তিনি এত ভালোভাবে শিখেছিলেন যে জীবনে কোনদিন ভুলেননি। কম্পিউটারের মতো দ্রুত গতিতে অঙ্ক করতে পারতেন। ঘরের বাইরে প্রথমে তাকে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়েছিল সান্তিয়াগো দি কিউবায় বোর্ডিং স্কুলে এবং তারপর লা সালে স্কুলে। নিজের শৈশব ও পড়াশোনা নিয়ে তার নিজের বক্তব্য- এক ভূস্বামীর ছেলে আমি। একজন প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাব আমি, এমন অবস্থা ছিল। ধর্মভিত্তিক স্কুলগুলোতে আমার লেখাপড়া। ধনীদের ছেলেরা পড়ত সেসব স্কুলে। প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাওয়ার মতো সেটাও একটা কারণ ছিল। আমি বাস করেছি কিউবায়। সেখানে সব চলচ্চিত্র, প্রকাশনা, গোটা গণমাধ্যম ‘য্ক্তুরাষ্ট্রে তৈরি’। প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাওয়ার মতো তৃতীয় কারণ হতে পারত সেটা। আমি পড়েছি এমন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিল মাত্র ৩০ জন। আমি হয়ে পড়ি সেই ৩০ জনের একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ভূস্বামী পুত্র হিসেবে। তার চেয়েও খারাপ, রাজনৈতিক দিক থেকে আমি ছিলাম মূর্খ। ভূস্বামীর সন্তান হলেও বসবাস করেছেন প্রান্তীয় মানুষদের সঙ্গে। শৈশব এবং শৈশবের এইসব মানুষ তার ওপর ব্যাপক প্রভাব রেখেছিল। সারা জীবন তাকে প্রভাবিত করেছে। শৈশবে খুব গরিব পরিবারগুলোর সঙ্গে আমার বসবাস করার সুযোগ হয়েছে। ...ছোটবেলায় যা দেখেছি, সারাজীবন তা মনে রেখেছি। হয়ত সেসব ছবি সেসব স্মৃতি মনের ওপর সেসব ছাপ আমার মধ্যে মানুষগুলোর জন্য মমতা আর একাত্মবোধ জাগিয়ে রাখে। তারপর তিনি পড়াশোনা করেন বেলেন এ কলেজে। এরপর হাভানা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। খেলাধুলাও পছন্দ করতেন। ১৯৪৪ সালে কিউবার সেরা অলরাউন্ডার স্কুল অ্যাথলেট পুরস্কার পান। আইন বিষয়ে ডিগ্রী নেওয়ার পরপরই হাভানায় একজন আইনজীবী হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন ফিদেল। আইন পেশায় দরিদ্র মক্কেলদের পক্ষে লড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে যোগ দেন। স্ত্রী, প্রেমিকা ও সন্তান বলা হয়ে থাকে ব্যক্তিগত জীবনে ৫ জন নারীর সংস্পর্শে এসেছিলেন ফিদেল। তাদের ঘরে ৯ সন্তানের জন্ম হয়। তার বড় ছেলে ফিদেল ক্যাস্ট্রো দিয়াজ-বালার্ট সোভিয়েত প্রশিক্ষিত পরমাণু বিজ্ঞানী। ফিদেলিতো নামেও পরিচিত দিয়াজের জন্ম ১৯৪৯ সালে। ফিদেলের প্রথম স্ত্রী মিরতা বালার্ট-এর গর্ভে জন্ম তার। পরে মিরতা বালার্ট-এর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। ফিদেলের মেয়ে আলিনা ফার্নান্দেজের জন্ম ১৯৫০-এর দশকে ক্যাস্ট্রো যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন তখন তার এক প্রেমিকার গর্ভে জন্ম নেন আলিনা। ১৯৬০ এর দশক থেকে ফিদেলের অঘোষিত স্ত্রী ডালিয়া সটোর ঘরে একে একে জন্ম নেয় ৫ ছেলে। এছাড়া ক্ষমতায় আসার আগে তার আরও দুই প্রেমিকার ঘরে জন্ম নেয় এক ছেলে ও এক মেয়ে। বিপ্লবের ধ্যান ধারণা ও মতাদর্শ বুর্জোয়া স্কুলেগুেেলাতে লেখাপড়া শিখেছে, মার্কিনী প্রচারণার শিকার হয়েছে যে ভূস্বমীর ছেলেটি, সে ভাবতে থাকলো, এ ব্যবস্থায় কিছু একটা গলদ আছে, এ ব্যবস্থাকে খুব যুৎসই মনে হয় না। এরকম একটা ভাবনা থেকেই একদিন তিনি হাতে পেলেন কমিউনিস্ট ইসতেহারের একটি কপি। সেখানের কথাগুলোকে মনে হলো সাংঘাতিক কথা, চরম সত্য কথা। সমাজের নানা শ্রেণীর বিভক্তির কথাগুলো মনে হলো খুব যুক্তিসঙ্গত। বজ্রাঘাত করলো তাকে। তারপর হাতে এলো লেলিনের দুটো বিখ্যাত বই, ওসঢ়বৎরধষরংস, ঃযব ঐরমযবংঃ ঝঃধমব ড়ভ ঈধঢ়রঃধষরংস, ঞযব ঝঃধঃব ধহফ জবাড়ষঁঃরড়হ. এই বই দুটো পড়ে তার অনুভূতি হয়েছিল -‘ এটা অনেকটা এ রকম, জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলার পর হঠাৎ করেই হাতে মানচিত্র চলে আসা।’ ‘আমার মাথায় অনেক ভাবনা গিজগিজ করতো। কিন্তু আমি তখনো কোনো দলে যোগ দেইনি। আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে এ কারণে যে অনেক চিন্তা মাথায় আসে। একজন কমিউনিস্ট হবার আগেই কিউবার রাজনৈতিক সঙ্কটের ঘূণাবর্তের মধ্যে আমি পড়ি আমি নিজেই নিজেকে দলে জড়াই আর লড়াই শুরু করি। ফিদেল সবসময়ই জোর দিয়ে বলেছেন তাকে পার্টির কোন সদস্য দীক্ষা দেননি। তবে তার ওপর বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ফেলে কিউবার বিপ্লবী বীর হোসে মার্তি আর কার্ল মার্কসের লেখাগুলো রাজনৈতিক জীবন, বিপ্লব ও তার শাসন কাল মাত্র ১৩ বছর বয়সে নিজের বাবার আখের খামারে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করেন এবং একটি ধর্মঘটের ব্যবস্থা করেন। বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই রাজনৈাতিক দুর্নীতির একটি ছাত্র গ্রুপে যোগ দেন তিনি। ১৯৪৭ সালে নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টির সদস্য হন। এ দলের বাম অংশের নেতা হয়ে ওঠেন। তুখোড় বক্তা ফিদেল দলের তরুণ সদস্যদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৫২ সালে দলীয় কংগ্রেসের সদস্য প্রার্থী হন ফিদেল। নির্বাচনের আগেই জেনারেল বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করলে নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। বিপ্লবের মাধ্যমেই রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন সম্ভব এ সিদ্ধান্ত নিয়ে মাত্র ১২৩ জন নারীপুরুষের একটি সশস্ত্র দল নিয়ে ১৯৫৩ সালে মনকাডা আর্মি ব্যারাকে হামলা করেন। সংঘর্ষে মাত্র ৮ জন নিহত হলেও ফিদেলের দল পরাস্ত হয় এবং বাতিস্তার নির্দেশে তার প্রায় ৮০ জন সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। ফিদেলকে আটককারী লেফটেন্যান্ট ‘বিদ্রোহীদের আটক করা মাত্র হত্যা করার নির্দেশ উপেক্ষা করে তাকে বেসামরিক কারাগারে পাঠিয়ে দিলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। কিন্তু কারাগারে তাকে বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। এবার দায়িত্ব ছিল ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারের ওপর। তিনি দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বরং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন। কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারকে। কিন্তু বিশ্ব জনমতের কথা বিবেচনা করে ফিদেলকে হত্যা না করে বিচারের মুখোমুখি করেন বাতিস্তা। মনকাডা হামলায় অভিযুক্ত হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফিদেল যে জবানবন্দী দেন তা পরবর্তীতে ‘হিস্ট্রি উইল অ্যাবসোল্ভ মি বা ‘ইতিহাস আমার পাপমোচন করবে’ নামে একটি বই আকারে বের হয়। ওই দীর্ঘ বক্তৃতায় কিউবার রাজনৈতিক সঙ্কট ও সমাধানের পথ নির্দেশ করেন। এতে রাতারাতি দেশব্যাপী বিখ্যাত হয়ে উঠেন এবং জননায়কে পরিণত হন ফিদেল। বিচারে তার ১৫ বছরের কারাদ- হলেও প্রবল জনমতের কাছে মাথা নত করে দু’বছরের মাথায় তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন বাতিস্তা। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বিপ্লবী দল গড়ার লক্ষ্যে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান ফিদেল। সেখানে একটি গেরিলা দল গঠন এবং পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ের পর চে গুয়েভারা, জুয়ান আলমেইডা এবং অন্যান্যদের মিলিয়ে প্রায় ৮০ জনের একটি বিপ্লবী দল নিয়ে ১৯৫৬ সালে কিউবায় ফিরে আসেন ফিদেল। গ্রানমা নামের একটি ছোট নৌকায় করে ফিদেলের বিপ্লবী দল কিউবায় এসে ভিড়ে। এই দলের বিপ্লবী কর্মকা- ‘জুলাই টোয়েন্টিসিক্স মুভমেন্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বতে নিজেদের ঘাঁটি গাড়ার লক্ষ্যে এগোনোর সময়ই বাতিস্তার সেনাদের আক্রমণের মুখে পড়েন তারা। সম্মুখ সমরে নিহত হয় বেশিরভাগ গেরিলা। মাত্র ১২ টি অস্ত্র আর ১৬ জন গেরিলা নিয়ে শেষ পর্যন্ত নিরাপদে ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হন ফিদেল। স্থানীয় দরিদ্র জনগণের আশ্রয় নিয়ে ধীরে ধীরে দল বাড়াতে থাকে আর সেনা চৌকিগুলোতে চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করতে থাকে জুলাই টোয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট। বিপ্লবী কর্মকা- ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ-যুবা-ছাত্র এ আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে। অন্যদিকে গেরিলাদের ধরতে বাতিস্তার অভিযানে নিপীড়নের শিকার হয় অগণিত সাধারণ মানুষ এমনকি নারী ও শিশুরাও। এতে গেরিলাদের প্রতি জনসাধারণের সমর্থন আরও বাড়তে থাকে। ১৯৫৮ সালে এসে কিউবার মধ্যবিত্ত শ্রেণীরও সমর্থন লাভ করেন ফিদেল। ওই বছর আইনজীবী, চিকিৎসক, স্থপতি, হিসাবরক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার ৪৫টি পেশাজীবী সংগঠন যুক্তভাবে এক খোলা চিঠিতে জুলাই টোয়েন্টি সিক্স মুভমেন্টকে সমর্থন জানায়। পেশাজীবীদের ওই খোলা চিঠির পর জেনারেল বাতিস্তা গেরিলা নিধন অভিযান আরও জোরদার করেন। এবারে ৩০০ বিশেষ সেনার নেতৃত্বে ১০,০০০ লোকের এক বিশাল বাহিনীকে পাঠানো হয় পার্বত্য অঞ্চলে। সংখ্যায় অনেক কম হলেও অসীম সাহসী গেরিলারা ধীরে ধীরে সম্মুখ সমরে জয়ী হতে থাকে এবং বহু সেনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। অনেকে পক্ষ ত্যাগ করে গেরিলা দলে চলে আসে। এভাবে ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ সেনাদলের আকার নিতে শুরু করে জুলাই টোয়েন্টিসিক্স মুভমেন্টের গেরিলা দল। ফিদেলের গেরিলারা এবার সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বত ছেড়ে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। স্থানীয় জনতা গেরিলাদের অভ্যর্থনা জানায়। ১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি বাতিস্তার প্রায় ১,০০০ সেনা গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারালে যুক্তরাষ্ট্র বিমান, বোমা, জাহাজ ও ট্যাংক পাঠিয়ে গেরিলাদের হঠানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু নাপাম বোমার মতো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও গেরিলাদের সঙ্গে বাতিস্তা পেরে না ওঠায় তাকে নির্বাচন দেওয়ার পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫৮ সালের মার্চে বাতিস্তা নির্বাচন দিলেও জনগণ সে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। ৭৫ ভাগ থেকে শুরু করে কোথাও কোথাও ৯৮ ভাগ মানুষই ভোটকেন্দ্রেই যায়নি। ফিদেলের সেনারা চারদিক থেকে রাজধানী হাভানাকে ঘিরে ধরতে শুরু করলে ১৯৫৯ সালের পহেলা জানুয়ারি নববর্ষের দিনে কিউবা ছেড়ে পালান জেনারেল বাতিস্তা। ১৯৫৯ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানী হাভানায় ঢুকে দেশের নিয়ন্ত্রণভার নিয়ে নেয় ফিদেল ক্যাস্ট্রোর গেরিলারা। হাভানা জয়ের পরপরই কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফিদেল। ১৯৬৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ কিউবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং কিউবাকে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের কাজ শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট অফ দ্য কাউন্সিল অফ স্টেটস এবং কাউন্সিল অফ দ্য মিনিস্টারস নির্বাচিত হন তিনি। একই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ২০০৬ সালের ৩১ জুলাই অন্ত্রের অস্ত্রোপচারের পর ছোট ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর কাছে সাময়িকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ফিদেল। পরবর্তীতে এই স্বাস্থ্যের কারণেই দুই বছর পর ২০০৮ স্থায়ীভাবে ক্ষমতা দিয়ে দেন ছোট ভাইকে? চে গুয়েভারা ও ফিদেল আর্জেন্টিনার ধনী পরিবারের সন্তান, মনোভাবে বিদ্রোহী তরুণ চে এর সঙ্গে রাউল ক্যাস্ট্রোর পরিচয় হয় ১৯৫৫ সালের জুন মাসে। পরে তার মাধ্যমেই বড় ভাই ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে পরিচিত হন চে। প্রথম সাক্ষাতেই তাদের দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়। এই প্রথম আলাপেই চে কিউবা বিপ্লবের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে জড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। ২৬ জুলাই আন্দোলন দলের সদস্য হন। তখন চে’র বয়স ছিল ২৭ আর ফিদেলের ২৯। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন চে এবং মনেপ্রাণে এই আগ্রাসনের সমাপ্তি চাচ্ছিলেন। মেক্সিকোতে চে আর ফিদেলের সঙ্গে ছিলেন কিউবা বিপ্লবের প্রখ্যাত যোদ্ধা হেসাস মনতাতে, তার স্মৃতিচারণে- তারা দুজন একই সময়ের মানুষ। তাদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটা নেহাত একটা ঘটনা। বাস্তব তত্ত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের ভাবনার মিল দু’জনের পরিচয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই ভাবনার মিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো বেড়েছে। চে আর ফিদেলের একই ব্যক্তিত্ব একই মেজাজ। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে প্রথম আলাপের স্মৃতিচারণ করে চে বলেছিলেনÑ সারা রাত ফিদেলের সঙ্গে কথা বললাম। সূর্য যখন উঠছে সেই সময়ের মধ্যে ফিদেলের আগামী অভিযানে আমি ডাক্তার হিসেবে যোগ দেব বলে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, লাতিন আমেরিকার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ভ্রমণের সময় এবং গুয়েতেমালায় আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তাতে এক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কোনো বিপ্লবে যোগ দেবার জন্য আমাকে খুব বেশি বোঝানোর কিছু ছিল না। এভাবেই ডাক্তার চে হয়ে গেলো বিপ্লবী। ফিদেলের জন্য চে একটি কবিতা লেখেন যার প্রথম লাইন কটি হলো -চলো যাই অগ্নিময় প্রত্যুষে/বালুকাময় আঁকাবাঁকা নির্জন পথ পেরিয়ে/তোমার ভালোবাসার সবুজ স্বপ্নময়/ দেশের মুক্তির জন্য/চলো যাই যে কারণে তিনি ইতিহাসের অংশ ফিদেল ক্যাস্ট্রোর শাসনকালের পুরোটাই নানা সঙ্কট আর নাটকীয়তায় ভরা। ঠা-া যুদ্ধের উত্তেজনা, পারমাণবিক যুদ্ধ, বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উৎকণ্ঠা, দেশে দেশে বামপন্থী আন্দোলনের বিস্তৃতি, আশির দশকে আবার সমাজতান্ত্রিক মতবাদের পতন, কিউবার প্রতি একটানা মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ এসব নানা উত্থান পতনের পরেও ফিদেল তার শাসনামলে কিউবাকে দিয়েছেন প্রথম বিশ্বের সমতুল্য শিক্ষার হার, খাদ্য নিরাপত্তা আর এক অনন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। কিউবানদের গড় আয়ু এবং শিশুমৃত্যুর অতি নিম্ন হারও পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে তুলনীয়- যদিও তাদের মাথাপিছু আয় উন্নত দেশগুলোর তুলনায় নগণ্য। ক্যাস্ট্রোর কিউবা টিকবে কি না এ নিয়ে ব্যাপক জল্পনা কল্পনা ও বিশ^ ভবিষ্যদ্বাণীর পরও তার কিউবা শুধু টিকেই থাকেনি বেশ কয়েকটি দেশে বামপন্থী বিপ্লবে শক্তি ও সহযোগিতাও জুগিয়েছে। গ্রানাডা, অ্যাঙ্গোলা, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও পেরুতে তিনি সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। সারা দুনিয়ার বিপ্লবীদের কিউবায় এসে বিপ্লবের প্রশিক্ষণ নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। লাতিন আমেরিকায় মার্কিন প্রভাব-আাধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন আজীবন, অনুপ্রাণিত করেছেন ভেনেজুয়েলার উগো চাভেজ, বলিভিয়ার ইভো মোরালেসের মতো নেতাদের। বেশ কয়েকটি উৎখাত চেষ্টা দমন করতে হয়েছে তাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ১৯৬১ সালে বে অব পিগসে সামরিক অভিযান। যে যুদ্ধে ক্যাস্ট্রো টিকে যান। ক্যাস্ট্রো কিউবা শাসন করেছেন প্রায় ৫ দশক ধরে। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ এবং থাইল্যান্ডের রাজার পর তিনি বিশ্বের তৃতীয় নেতা, যিনি এতো লম্বা সময় দেশ শাসন করেছেন। জাতিসংঘে সবচেয়ে দীর্ঘ ভাষণ দেয়ার রেকর্ডটিও তার দখলে। ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে ৪ ঘণ্টা ২৯ মিনিটের ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। ৬৬৮ বার মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল তাকে। ২০১২ সালে টাইম ম্যাগাজিনের প্রকাশিত ১০০ জন সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি একজন। জীবনের শেষ দিনগুলো “আমি এখন সেই কাজটাই করছি, যেটা বুড়ো বয়সে সবাই করে। ভাবি আর লিখি। আমার অনেক কাজই অসমাপ্ত হয়ে রইল। ক্ষমতা ছাড়ার পরও তিনি জনসম্মুখে আসতেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ধীরে ধীরে জনসম্মুখে আসা কমিয়ে দেন। গণমাধ্যমে তার প্রায় শতাধিক লেখা প্রকাশিত হয়। ২০১২ সালে দু’বার এবং ২০১৩ সালে দু’বার তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়। গত এপ্রিলে হাভানায় কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে তিনি জনসন্মুখে আসেন এবং শেষ ভাষণে বলেন, ‘শিগগিরই নব্বইয়ে পড়ব...অন্য সবার কাতারে মিশে যাব, একে একে আমাদের সবারই পালা আসে। এক অবিনাশী বিপ্লবী ‘আমি সারা জীবন নিজেকে একজন সুখী মানুষ হিসেবেই দেখেছি। এর কারণ মনে হয় এই, আমি ঠিক রাজনৈতিক ভাবনাটাকে পেয়েছি, কিউবার রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করেছি এবং মার্ক্সবাদে মুক্তির পথ দেখেছি’। মার্কবাদ আর বিপ্লবে যিনি মুক্তির পথ দেখেছিলেন তাকে যেমন দেখা হয় বিপ্লবের মহানায়ক হিসেবে। স্বৈরাচারী শাসন থেকে কিউবার মুক্তিদাতা হিসেবে। তেমনি দীর্ঘকাল ক্ষমতা ধরে রেখে তিনি কুড়িয়েছেন ব্যাপক সমালোচনা। একনায়ক হিসেকে তাকে চিহ্নিত করা হয়। কঠোর হাতে দেশ শাসন ও বিরুদ্ধমতের প্রতি অসহিষ্ণু হিসেবেও বদনাম কুড়িয়েছেন তিনি। এরকম নানা মত আর বিরুদ্ধ মতের বিপরীতেও কমিউনিস্ট ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণালী অধ্যায় হয়ে থাকবে। সাহস আর আদর্শেও প্রতীক হয়ে থাকবেন তিনি। জনমানুষের নেতা হিসেবে অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন। জীবিত থাকাকালীনই তিনি কমিউনিজমের কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। তার প্রস্থান সূচনা করবে নতুন ইতিহাস, বিশ^কে পথ দেখাবে আসল ফিদেলকে আবিষ্কার করার। আমার দেশটাকে আমি স্বর্গ বলে মানি। আমি বারবার বলেছি, আমরা নরকে বাস না করে এই স্বর্গেই মরতে চাই। যে দেশ টাকে স্বর্গ বলে মানতেন সেই দেশের মুক্তির জন্য যে আদর্শকে বেছে নিয়েছিলেন সেটাকেই অবিচল আঁকড়ে থেকেছেন আজীবন। তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে তার জীবনী লিখেছেন যারা তাদের অন্যতম গেওর্গি এন গোয়ার লিখেছেন ক্যাস্ট্রোর সমাধিফলকে লেখা থকবে- ‘সত্যিকার অর্থে শেষ কমিউনিস্ট’ কথাটায় বিদ্রƒপ আছে, তিনি শেষ কমিউনিস্ট কি না তা ইতিহাস নির্ধারণ করবে, তবে সত্যিকার অর্থেই তিনি শেষ পর্যন্ত ‘এক অবিনাশী বিপ্লবী’। তথ্য সূত্র- ‘আমার কৈশোর আমার তারুণ্য’- ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইন্টারনেট ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকা [email protected]
×