ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কলেজ জাতীয়করণ ইস্যু নিয়ে ফুলবাড়িয়ায় সহিংসতার নেপথ্যে-

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

কলেজ জাতীয়করণ ইস্যু নিয়ে  ফুলবাড়িয়ায় সহিংসতার নেপথ্যে-

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ ॥ কলেজ জাতীয়করণের ইস্যুতে স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নির্লিপ্ততা আর আন্দোলনকারীদের হতাশাবোধ থেকেই চলমান আন্দোলন কর্মসূচীর দেড় মাসের মাথায় গত ২৭ নবেম্বর ফুলবাড়িয়ার সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। গবর্নিং বডির নিয়োগ বাণিজ্য আর লুটপাটসহ দুর্নীতিপরায়ণ কলেজ অধ্যক্ষ নাসির উদ্দিন খানের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অসন্তোষের বহির্প্রকাশ যুক্ত হয় এর সঙ্গে। এসব কারণে বঞ্চিত শিক্ষক শিক্ষার্থী ও কর্মচারীসহ ফুসে উঠে ফুলবাড়িয়াবাসী। ফুলবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজ জাতীয়করণের দাবি নিয়ে মাঠে নামে আন্দোলনকারীরা। গা ঢাকা দেয় কলেজ অধ্যক্ষ নাসির খান। এলাকা ছাড়েন স্থানীয় সংসদ সদস্য। এ সময় আন্দোলনকারীদের যৌক্তির দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় স্থানীয় অভিভাবক, আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ ও মুক্তিযোদ্ধাসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। ফুলবাড়িয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা ও আন্দোলনকারীসহ স্থানীয় নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলার পর এসব তথ্য বের হয়ে এসেছে। বুধবার ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের উপস্থিতিতে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন খোদ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। এ নিয়ে ধর্মমন্ত্রী নিজেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন মন্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিলে এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিয়ে বসতে পারলে হয়তবা এই সহিংসতার ঘটনা ঘটত না ফুলবাড়িয়ায়। আর বৈঠকে উপস্থিত ফুলবাড়িয়ার স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের দাবি তিনি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকে বসার উদ্যোগ নিয়েছেন, সমস্যা সমাধানে আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দকে ডেকে পাঠিয়েছেন, কিন্তু তার ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতৃবৃন্দ স্থানীয় সংসদ সদস্যের এ ধরনের বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, সংসদ সদস্য গণমাধ্যমের কাছে চরম অসত্য কথা বলেছেন। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা ঘটনার দায় প্রশ্নে জনকণ্ঠকে জানান, আন্দোলনকারীদের ডেকে তেমন সাড়া না পাওয়ায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেননি তিনি। এ দাবির বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ফুলবাড়িয়ার সহিংসতার দায় এড়াতে পারে না। ফুলবাড়িয়া আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক জানান, সময়মতো উদ্যোগ নিলে হয়ত বা এই সহিংসতা এড়ানো যেত। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কর্মকর্তারা বুধবার ফুলবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজের ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গত ২৭ নবেম্বর ফুলবাড়িয়ায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ও পুলিশের সংঘর্ষের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি সরকারকে অবহিত করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি প্রধান অধ্যাপক আক্তার হোসেন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সরকারীকরণের তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ার খবরে গত অক্টোবর থেকে ফুলবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজ সরকারীকরণ দাবি আদায় কমিটির ব্যানারে আন্দোলনে নামে কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা। হরতাল অবরোধ মানববন্ধন বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ গণঅনশন সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি প্রদানসহ দাবি আদায়ে নানা কর্মসূচী পালন করে আন্দোলনকারীরা। ফুলবাড়িয়া ছাড়াও ময়মনসিংহ জেলা শহর ও রাজধানী ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের মতো কর্মসূচী পালন করেও আন্দোলনকারীরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়। কলেজ সরকারীকরণের এ আন্দোলনে স্থানীয় অভিভাবক, কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ, মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ এসব আন্দোলন মিছিল সমাবেশে যোগ দিয়ে সমর্থন জানায়। টানা দেড় মাসের আন্দোলনে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লীরা তরফদার, জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন ও ডিআইজি ময়মনসিংহ রেঞ্জ চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের মাধ্যমে কলেজ সরকারীকরণের দাবি পূরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আলাদা স্মারকলিপি প্রদান করেন আন্দোলনকারীরা। ফুলবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজ সরকারীকরণ দাবি আদায় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আবুল হাশেম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন টানা দেড় মাসের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচীর পরও কোন মহল থেকে কলেজ সরকারীকরণের কোন আশ্বাস মেলেনি। এমনকি সমস্যা সমাধানেও কোন উদ্যোগ নেয়নি কোন মহল। স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের কাছ থেকেও আন্দোলনকারীরা কোন ভরসার বাণী শুনতে পাননি। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও আন্দোলনকারীদের দাবি আদায় কিংবা সমস্যা সমাধানে নির্বিকার থাকেন বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের। ফলে দিন দিন ক্ষোভ আর অসন্তোষসহ হতাশাবোধ থেকে ফুসে উঠতে থাকে আন্দোলনকারীরা। শিক্ষকদের চেন অব কমান্ড ভেঙ্গে দাবি আদায়ে নিয়ন্ত্রণহীন ও বেপরোয়া হয়ে উঠে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। নিয়মিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও ক্লাস বর্জন করে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। এমতাবস্থায় উত্তাল ও টালমাটাল ফুলবাড়িয়ায় নির্ধারিত কর্মসূচী বাতিল করে রাতের আঁধারে পুলিশ আর প্রশাসনের পাহারায় গত ২৪ নবেম্বর নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঢোকেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। এরপর থেকেই মূলত দানা বেঁধে উঠে আন্দোলন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কলেজ গবর্নিং বডির নিয়োগ বাণিজ্য আর লুটপাটসহ দুর্নীতিপরায়ণ কলেজ অধ্যক্ষ নাসির খানের স্বেচ্ছাচারিতার পুরনো ইস্যু। কলেজ গবর্নিং বডির সভাপতি হচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন। গবর্নিং বডির সদস্য সংসদ সদস্যের পুত্র এ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিম। কলেজ অধ্যক্ষ নাসির খান হচ্ছেন সেলিমের ভায়রা ভাই। স্থানীয় সংসদ সদস্যের মেয়ে ফারজানা শারমিন বিউটি ও পুত্র সেলিমের স্ত্রী বিলকিস খান পাপড়ি এই কলেজের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় এই কমিটির মেয়াদে। শিক্ষকদের অভিযোগ এই গবর্নিং বডির মেয়াদে সকল নিয়ম ভঙ্গ করে প্রায় ১০০ শিক্ষক ও কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কলেজ ভা-ার থেকে এ সময় হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা! এ নিয়ে কলেজের ভেতরে-বাইরে কোন অডিট করতে দেয়া হয়নি এ সময়ে। কলেজ অধ্যক্ষ নাসির খানের চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয় ৫ দফায়। প্রচার রয়েছে, সর্বশেষ কলেজ সরকারীকরণের নামে শিক্ষক কর্মচারীদের কাছ থেকে ‘স্পিড মানি’ হিসাবে ১০ লাখ টাকা নেন গবর্নিং বডির সভাপতি এ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন এমপি। কলেজ সরকারীকরণ করা হলে লুটপাটের ভা-ার বন্ধ হয়ে যাবে বলে তলে তলে এর বিরোধিতা করেন স্থানীয় এই সংসদ সদস্য ও কলেজ অধ্যক্ষ নাসির খান। বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে আন্দোলন চলাকালে সহকর্মী আর জনরোষের ভয়ে গা ঢাকা দেন নাসির খান। অনেকটা এলাকা এড়িয়ে থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্যও। ধর্মমন্ত্রীর সামনে স্থানীয় সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত বুধবারের বৈঠকে শিক্ষকদের এই অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন। এসব ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
×