ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয়ের মাস

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

বিজয়ের মাস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ অপরাধীর ক্ষমা নেই, ঠিক যেমন ক্ষমা পায়নি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, আলী আহসান মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা ও মীর কাসেম। দেশের মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। সঙ্গত কারণে এবার বিজয়ের মাস এলো এক ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে। একাত্তরের শহীদদের প্রতি দায় কিছুটা হলেও শোধ হলো। শুরু হলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালী জাতি নিজস্ব মানচিত্রের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পায়। ’৭১-এর এই দিনে সূচিত হয় নতুন মানচিত্রে নতুন এক জাতীয়তার। বছর ঘুরে আবার এসেছে বাঙালীর অহঙ্কার; বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালী তার আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা ও স্বাধীন পতাকা পেয়েছিল যে মাসে তার নাম ডিসেম্বর। বিজয়ের পঁয়তাল্লিশ বছর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এ বিজয় শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ও মহান আত্মত্যাগ। মুক্তিপাগল বাঙালী জাতি একসাগর রক্তের বিনিময়ে এ ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে আনে হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই ডিসেম্বর হচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি ও ভূখ-ের স্বীকৃতি আদায়ের মাস। ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসন-শোষণকে পদানত করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল সন্তানদের ছিনিয়ে আনা বীরত্বগাথা বিজয় অর্জনের মাস। ৪৫ বছর আগের ২ ডিসেম্বর। একাত্তরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর যতই এগিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যেন ততই এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় মেতে ওঠে হিংস্র পাক হানাদার বাহিনী। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহের দিকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজি তার রাজাকার, আলবদর ও সেনাবাহিনীকে দেশের চারদিকে ছড়িয়ে দেয় নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালাতে। কিন্তু তখনও হানাদার বাহিনী বুঝতে পারেনি তাদের পতন অত্যাসন্ন। একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। অপ্রতিরোধ্য বাঙালীর বিজয়রথে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুরসব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে। পরাজয়ের আভাস পেয়ে তৎকালীন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন মরিয়া হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি চিঠি পাঠান। ইয়াহিয়া তার চিঠিতে যুদ্ধকালীন সাহায্যের আশায় ১৯৫৯ সালের পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির এক অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। সীমান্ত এলাকায় পাক জান্তারা সমরসজ্জা বৃদ্ধি করায় ভারতও তা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ত্রিমুখী যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। এসব দেখেশুনে ভারত সরকার বুঝেছিল, পাকিস্তান যুদ্ধ করবেই। ভারত তখন যে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা বা আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে তা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে ভারত সামরিক প্রস্ততি চালিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমের প্রস্তুতি দেখে এবং নাশকতামূলক কাজের লোক ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত মোটামুটি পরিষ্কার বুঝে ফেলেÑ পাকিস্তান রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবে না, বরং লড়াই-ই করবে। তাই তখন থেকে ভারতের প্রস্তুতিও জোরদার হয়েছিল। অন্যদিকে বীর বাঙালীর গেরিলা আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে পাক সৈন্যরা। যতই সময় গড়াচ্ছিল গেরিলা আক্রমণ ততই প্রবল হতে থাকে। পাক সৈন্যদের হাতে তখনও আধুনিক অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পরাস্ত করতে থাকেন। মুক্তিপাগল বাঙালীর অকুতোভয় লড়াইয়ে পাক হানাদারদের রাতে চলাফেরাও কঠিন হয়ে পড়ে। নিয়াজী বুঝতে পারে, এবার বড় ধরনের কিছু করতে না পারলেই নয়। তাই মার্কিন সাহায্য নিশ্চিত, নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি, রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ এ দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে নিয়ে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালানোর জঘন্য পরিকল্পনা আঁটতে থাকে কসাই নিয়াজী। বর্ণাঢ্য আয়োজনে বৃহস্পতিবার থেকে ডিসেম্বর মাসব্যাপী বিজয় উৎসব কর্মসূচী পালন শুরু হয়েছে। সত্যিই এক অন্যরকম পরিবেশে এবার বিজয়ের মাস পালন করছে বাঙালী জাতি। শত ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় একে একে কার্যকরের মাধ্যমে দেশকে অনেকটাই কলঙ্কমুক্ত করেছে বর্তমান সরকার। বাকি যুদ্ধাপরাধীদেরও রায় কার্যকরের মাধ্যমে দেশকে সম্পূর্ণ কলঙ্কমুক্ত করার প্রচ- দাবি নিয়েই এবার কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি পালন করছে বিজয়ের মাসের নানা কর্মসূচী। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে ধানম-ির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে মোমবাতি প্রজ্বলন, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পালন করে বিভিন্ন সংগঠন। সংগঠনটির সহস্রাধিক নেতাকর্মী আলোর মিছিলের মাধ্যমে স্মরণ করেন একাত্তরের বীর শহীদদের। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সামনে বিজয় র‌্যালির উদ্বোধনকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক বলেন, যুদ্ধাপরাধী এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মতো জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে খালেদা জিয়াকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। এতে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস এমপি, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও বিজয়ের মাসের প্রথম দিন ক্যাম্পাসে বিজয় র‌্যালি বের করা হয়।
×