ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফিলিপিন্স ঘুরে এসে সাংবাদিকদের জানালেন আইনমন্ত্রী

রিজাল ব্যাংককে অর্থ ফেরত দিতেই হবে, সরকার আমাদের পক্ষে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

রিজাল ব্যাংককে অর্থ ফেরত দিতেই হবে, সরকার আমাদের পক্ষে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকিং কর্পোরেশনকে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরত দিতেই হবে বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। তিনি বলেন, ফিলিপিন্স সরকার বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে। বাংলাদেশের হয়ে এই অর্থ আদায়ের জন্য ফিলিপিন্স সরকার ও সিনেট লড়ে যাবে। টাকা ফেরত প্রদানে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানের কথা জানিয়েছে। শীঘ্রই দেশটির সিনেটে শুনানিতেও আরসিবিসির দায় নিয়ে ফের আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নিয়ম ভাঙ্গার কারণে জরিমানা এবং সেই জরিমানা পরিশোধ করার মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে, আরসিবিসি তার অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তাই রিজার্ভ থেকে চুরিকৃত অর্থ আরসিবিসিকে (রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন) ফেরত দিতেই হবে। বৃহস্পতিবার নিজ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক এসব কথা বলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে চুরি যাওয়া রিজার্ভের এক-পঞ্চমাংশ ফেরত পাওয়ার পর বাকি অর্থ উদ্ধারে ফিলিপিন্সে তৎপরতা চালিয়ে বুধবার রাতে দেশে ফিরে আসেন আইনমন্ত্রী। এর আগে গত শনিবার আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল ফিলিপিন্সে যায়। তাদের সফরের মধ্যেই এক বিবৃতিতে রিজালের আইনজীবী থিয়া দায়েব অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর দায় চাপান। রিজার্ভ চুরি নিয়ে আইনমন্ত্রী কথা বলতে পারেনÑ এ কারণে সকাল থেকে তার দফতরে সংবাদকর্মীদের ভিড় বাড়তে থাকে। পরে এসব বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন আনিসুল হক। আইনমন্ত্রী বলেন, চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে ফিলিপিন্সে আইনী লড়াই অব্যাহত রাখা হবে। ফিলিপিন্সের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানানো অনৈতিক। কারণ তারা এ ঘটনায় দায় স্বীকার করেছে। এখন অর্থ ফেরত দিতে না চাওয়া অগ্রহণযোগ্য। তাদের অর্থ ফেরত দিতেই হবে। এদিকে দায় অস্বীকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরত দিতে রিজাল ব্যাংক অস্বীকৃতি জানালেও ফিলিপিন্স সরকারের মাধ্যমে তাদের বাধ্য করানো যাবে বলে আশা করছেন আনিসুল হক। ফিলিপিন্স সরকার বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে দাবি করে তিনি বলেছেন, এই টাকা আরসিবিসিকে ফেরত দিতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে ভুয়া সুইফট বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকে পাঠানো হয়েছিল। ওই অর্থ পরে জুয়ার টেবিলে চলে যায়। বিশ্বজুড়ে তোলপাড়ের মধ্যে ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটি এ ঘটনার তদন্ত শুরুর পর এক ক্যাসিনো মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধারের পর তা ফেরত পায় বাংলাদেশ। তদন্তে রিজাল ব্যাংকের নানা ফাঁক-ফোকর বেরিয়ে আসার পর অর্থ ফেরতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিবৃতি দিলেও তাতে তাদের দায় স্বীকারের প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী। আরসিবিসি ভয় পাচ্ছে যে তাদের টাকাটা দিতে হবে। সেজন্য অনেক রকম গান তারা গাওয়া শুরু করেছে। বাকি সাড়ে ৬ কোটি ডলার উদ্ধারে গিয়ে ফিলিপিন্সের মন্ত্রিসভার দুই সদস্য এবং সিনেটের সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ফিলিপিন্স সরকার টাকা আদায়ে সদিচ্ছা প্রকাশ করেছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, তারা বাংলাদেশের পক্ষে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমাদের কথায়-কাজে-বডি ল্যাংগুয়েজে বুঝিয়েছেন। আনিসুল হক বলেন, সিনেটে শুনানিতে আরসিবিসির দায় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। মাঝে দেশটিতে নির্বাচনের কারণে তা বন্ধ থাকলেও অচিরেই তা শুরু হবে বলে আইনমন্ত্রীকে বলা হয়েছে। সিনেট সভাপতিকে উদ্বৃত করে আনিসুল হক বলেন, তিনি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলেছেন, অন্যায়ভাবে কেউ লাভবান হোক, তাদের সরকার তা হতে দেবে না। অন্যায়ভাবে কারও অর্জিত আয়ের টাকা কেউ রেখে দেবে, সেটাও ফিলিপিন্স সরকার হতে দেবে না। এই কথাও পরিষ্কারভাবে বলেন, বাংলাদেশের হয়ে এই অর্থ আদায়ের জন্য ফিলিপিন্স সরকার ও সিনেট লড়ে যাবে। ফিলিপিন্সের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে নিয়ম ভাঙ্গার জন্য রিজাল ব্যাংককে সেদেশে ২ কোটি ডলার জরিমানার বিষয়টি তুলে ধরেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। এই জরিমানা এবং জরিমানা পরিশোধ করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, আরসিবিসি তার অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। সে কারণে তাদের সম্পূর্ণ টাকা বাংলাদেশকে ফেরত দিতে হবে। এটাকে ফিলিপিন্সের অর্থমন্ত্রী অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত বলেছেন। ফিলিপিন্সের আইন প্রতিমন্ত্রী এবং মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের সঙ্গেও দেখা করেছেন আনিসুল হক। আইনমন্ত্রী আরও জানান, ফিলিপিন্সে এ বিষয়ে সরকার ও আরসিবিসি দুটো মামলা করেছে। একটায় ৬ জন কর্মকর্তা, আরেকটায় দুই-তিনজন আসামি আছেন। সেখানেও আমাদের যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। আরসিবিসিকে ফেরত দিতে হবে। রিজাল ব্যাংকের এই শাখার মাধ্যমে হাপিস হয় বাংলাদেশের অর্থ-এক সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ক্যাসিনোতে আটকে আছে বলে যুক্তি আমি মানব না। মুদ্রা পাচারের যে কোন ঘটনাকে এখন বিশ্বের সব দেশ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে ফিলিপিন্স সরকার নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায় বাংলাদেশের অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেবে বলে আমরা আশাবাদী। তবে কী পরিমাণ টাকা ফেরত আসতে পারে- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কথা ৬৬ মিলিয়নই আসবে। প্রথম কথা হচ্ছে- আমরা ফিলিপিন্সে আইনী লড়াই অব্যাহত রেখে যাব। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্স সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি, তারা যদি টাকা আদায়ে অন্য কোন পন্থা করে, সেখানেও আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। টাকা ফেরত আসতে কতদিন লাগবে- এ প্রশ্নে আনিসুল হক সময় বেঁধে দেয়ার কথা বলতে চাননি। এই অর্থ ফেরতে নিউইয়র্ক ফেডকে না জড়ানোর পক্ষপাতি আইনমন্ত্রী। যদিও একদিন আগে অর্থমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকটির বিরুদ্ধে মামলার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। আনিসুল হক বলেন, ফেডারেল ব্যাংককে আনার কোন কথা হয় নাই- সেটা পরিষ্কার। এটাও আমি বলে দিতে চাই, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে তাদের অংশগ্রহণের কোন স্থান নাই। ফেডারেল ব্যাংকের ব্যাপারটা আলাদা। ফিলিপিন্সে যেহেতু টাকাটা ল্যান্ড করেছে, আরসিবিসিতে যেহেতু টাকাটা ছিল, তারা যেহেতু স্বীকার করেছে, তাদের কাছে টাকা রয়েছে, এজন্য এখানে অন্য কোন পার্টির অংশগ্রহণের জায়গা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করার পক্ষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অবস্থান সমর্থন করেন আনিসুল হক। অর্থমন্ত্রীকে বলেছিলাম, ওইখানে অবস্থান না বুঝে এইখানে প্রতিবেদন যদি প্রকাশ করা হয়, তাহলে হয়ত এটা একটা বিপরীত প্রক্রিয়া হতে পারে। আইনমন্ত্রী বলেন, আরসিবিসি ভয় পাচ্ছে যে, তাদের টাকাটা দিতে হবে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কে কী দোষ করেছে, এটার সঙ্গে সেটা সম্পৃক্ত নয়। তার কারণ হচ্ছে, চোরাই মাল এবং সেটা কোথায় গিয়ে ল্যান্ড করেছে, চোরাই মাল-জানা সত্ত্বেও তারা কী করেছে- সেটাই আরসিবিসির দোষ। সেই কারণেই আমরা বলছি, আরসিবিসিকে টাকা ফেরত দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কে দোষী সেটা ভিন্ন ব্যাপার। ভিন্ন ব্যাপারের ব্যবস্থা ভিন্নভাবে করা হবে।
×