ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ খোশ আমদেদ মাহে রবিউল আউয়াল

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ খোশ আমদেদ মাহে রবিউল আউয়াল

মাহে রবিউল আউয়াল এসেছে। আরবী চান্দ্রসনের তৃতীয় মাস এই রবিউল আউয়াল। রবিউল আউয়াল অর্থ প্রথম বসন্ত। এই মাসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবিহ সাদিক ওয়াক্তে প্রিয়নবী সরকারে দো আলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম নূরের অবয়ব নিয়ে মানব সুরতে ধরাধামে তশরীফ আনেন। তিনি যখন ভূমিষ্ঠ হচ্ছিলেন তখন তাঁকে ধরেছিলেন হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর মাতা হযরত শিফা (রাদি.)। তাঁর বর্ণনা মতে শিশুটি যখন তাঁর হাতে এলো তখন মাতা আমেনার জীর্ণ কুটির আলোয় আলোয় ভরে গেল এবং বাইরে থেকে বহু লোকের আনাগোনার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরবর্তীকালে গবেষণা করে দেখা গেছে ফেরেশতারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করেছিলেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যেদিন আরবের মক্কা নগরীর কা’বা শরীফের ৬০ মিটার পূর্বদিকে অবস্থিত মা আমেনার জীর্ণ কুটিরে অবতীর্ণ হলেন তার পঞ্চাশ দিন পূর্বে ইমেনের খ্রীস্টান শাসক আবরাহা বিরাট এক হস্তি বাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণ করতে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে এসে ছাউনি ফেলে। কিন্তু আল্লাহ জাল্লা শানুহু এক ঝাঁক আবাবিল পাঠিয়ে সেই বাহিনীকে তছনছ করে দেন। কুরআন মজীদের ১০৫ নম্বর সূরা ফিলে ইরশাদ হয়েছে : তুমি কি দেখোনি তোমার রব হস্তি অধিপতিদের প্রতি কী করেছিলেন? তিনি (আল্লাহ্) কি ওদের কৌশল ব্যর্থ করে দেননি? ওদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি (আবাবিল) প্রেরণ করেন, যারা ওদের ওপর প্রস্তর-কঙ্কর নিক্ষেপ করে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ্) ওদেরকে ভক্ষিত তৃণসদৃশ করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম মা আমেনার পবিত্র গর্ভে থাকাকালেই তাঁর আব্বা আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেন। ৬ বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। ৮ বছর বয়সে তিনি দাদাকে হারান। চাচা আবু তালিব তাঁর লালন-পালনের ভার নেন। অল্প বয়সে তিনি আল-আমিন ও আস্ সাদিক খিতাবে ভূষিত হন। ২৫ বছর বয়সে তিনি আরবের ধনী মহিলা খাদিজার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ৪০ বছর বয়সে তিনি ওহী লাভ করেন। মক্কার কাফির মুশরিকরা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র নির্দেশে মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করেন। মক্কা থেকে ২৯৬ মাইল সোজা উত্তরে অবস্থিত মদিনায় এলে তাঁকে মদিনাবাসী বিপুল সংবর্ধনা জানালেন। মদিনা এসে তিনি এখানে স্থাপন করলেন একটি মসজিদ। এই মসজিদের নাম মসজিদুন নববী। এই মসজিদকেন্দ্রিক গড়ে তুললেন একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র। এই কল্যাণ রাষ্ট্রের পরিচালনার জন্য প্রণয়ন করলেন একটি শাসনতন্ত্র, যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। এই শাসনতন্ত্র চার্টার অব মদিনা বা মদিনার সনদ নামে সমধিক পরিচিত। এই সনদ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করে। মদিনা নগররাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য মক্কার কাফির মুশরিকরা মদিনার ইয়াহুদী ও মুনাফিকরা জোট বাঁধে। তারা মদিনা আক্রমণ করে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। অতঃপর মক্কা জয় হয়। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামের পাতাকা উড্ডীন হয়। ঘোষিত হয় : এবং বল, ‘সত্য আসিয়াছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হইয়াছে;’ মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই। (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ৮১)। মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ঐতিহাসিক গীবন বলেন : ওহ ঃযব ষড়হম ষড়হম যরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ ঃযবৎব রং হড় রহংঃধহপব ড়ভ সধমহধহরসরঃু ধহফ ভড়ৎমরাবহবংং যিরপয পধহ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয ঃযড়ংব ড়ভ গড়যধসসধফ যিবহ ধষষ যরং বহবসরবং ষধু ধঃ যরং ভববঃ ধহফ যব ভড়ৎমধাব ঃযবস ড়হব ধহফ ধষষ. ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের জিলহজ মাসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৯ জিলহজ হজের দিনে প্রায় দেড় লক্ষাধিক সাহাবায়ে কিরামের সমাবেশে আরাফাত ময়দানে যে হজের খুতবা দিলেন তা মানবসভ্যতার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ খুতবা বা ভাষণ। সেই ভাষণের শুরুতে আল্লাহ্র হাম্দ পেশ করে বললেন : হে মানবম-লী! আইয়ামে জাহিলিয়াতের সকল কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, অনাচার আমার পদতলে দলিত-মথিত হলো। জাহিলিয়াত যুগের শোনিত-প্রতিশোধ রহিত করা হলো। জাহিলিয়াত যুগের কুৎসিত প্রথা বাতিল করা হলো। দীর্ঘ সেই ভাষণে তিনি বললেন : আজকের এই দিনটির মতো, এই মাসটির মতো, এই জনপদ (মক্কা মুকাররমা)-এর মতো তোমাদের একের রক্ত, মানসম্মান, ধনসম্পদ অপরের নিকট অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। যদি কর্তিতনাশা কাফ্রি গোলামকে তোমাদের আমির নিযুক্ত করা হয় এবং সে যদি আল্লাহ্র কিতাব অনুযায়ী তোমাদের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে তাহলে অবশ্যই তার অনুগত থাকবে। তার আদেশ মান্য করবে। সাবধান, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক কওম ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বললেন : তোমরা আল্লাহ্র জিম্মাদারিতে তোমাদের স্ত্রীদের গ্রহণ কর। তাদের ওপর তোমাদের যতটুকু অধিকার তোমাদের ওপর তাদেরও ততটুকু অধিকার। তিনি সেই দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায় বললেন : কোন অনারবের ওপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন কালোর ওপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন সাদার ওপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। তোমরা সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে। তিনি বললেন : আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর রসূলের সুন্নাহ। এই দুটোকে আঁকড়ে থাকলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। সেই ভাষণ শেষে তিনি হাত নেড়ে সবাইকে আল বিদায় জানান। এমন সময় আল্লাহ্র ওহী নাযিল হলো : আল্ ইয়াওমা আকমালতুলাকুম দীনাকুম ওয়া আত্মাম্তু আলায়কুম নি’মাতি ওয়া রাদিতুলাকুমুল ইসলামা দীনা- আজ তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩)। সেই হজ শেষে তিনি মদিনা ফিরে এলেন এবং প্রায় ৯০ দিন পর ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার মসজিদুল নববীতে হযরত আয়েশা রাদি আল্লাহু তায়ালা আন্হার হুজরায় তাঁর কোলে মাথা রাখা অবস্থায় রফীকুল ’আলার কাছে চলে গেলেন। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×