ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ছে দ্রুত-প্রতিকার দরকার

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ছে দ্রুত-প্রতিকার দরকার

‘ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আমেরিকান পলিসি’ নামীয় একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ কিছু তথ্য আরেক বিখ্যাত ‘ফরবস ম্যাগাজিনে’ ছাপা হয়েছে। কাগজে প্রকাশিত ওই তথ্যানুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ পড়ুয়া ‘ফুলটাইম গ্র্যাজুয়েট’ ছাত্রছাত্রীদের ৭০ শতাংশই বিদেশী। ‘গ্র্যাজুয়েট’ মানে মাস্টার্স ও পিএইচডি সব মিলিয়ে। এদিকে ‘কম্পিউটার সায়েন্সে’ পাঠরত গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের ৬৩ শতাংশই বিদেশী। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্থনীতি, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যায়নরত গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেকেই বিদেশী। এই খবরটিতে চমক কিছু নেই। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ইত্যাদি উন্নয়নশীল দেশ থেকে যেভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ছেলেমেয়েরা যুক্তরাষ্ট্রে যায় প্রতিবছর পড়াশোনা করতে তাতে ‘ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আমেরিকান’ পলিসির এই তথ্য মোটেই চমকপ্রদ খবর কিছু নয়। ‘ফাউন্ডেশন’ আরও বলছে, পড়াশোনা শেষে এই ছেলেমেয়েরা যার যার দেশে ফেরে না। তারা যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যায়, বড় বড় চাকরিতে ঢোকে। টেকনিক্যাল, হাইটেক জবে ঢোকে এসব এশীয় ছাত্রছাত্রী। এখানেই বেধেছে গোল। এটা ট্রাম্প সাহেবের নির্বাচনী ইস্যু হয়। আমেরিকানদের চাকরি নেই। শুধু বড় চাকরি, টেকনিক্যাল জব নয়, ছোট ছোট চাকরিতেও আমেরিকানরা নেই। সেসবও দখল করেছে বিদেশীরা। বড় বড় কোম্পানি চাকরি পাচার করেছে বিদেশে। তার নাম ‘আউট সোর্সিং’। এক খবরে দেখা গেছে, বিগত কয়েক বছরে প্রায় ১৬ হাজার মার্কিন কল-কারখানা ও কোম্পানি বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছে মার্কিনীরা। ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে অটোমেটেড। উন্নয়নের পাশাপাশি যত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রে। উচ্চস্তরে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার সুযোগ নিয়েছে বিদেশীরা। এখানেই নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘হিট’ করেছেন। মার্কিনীদের বলেছেন এই দুঃখের কথা। উন্নয়ন মানে বিদেশীদের চাকরি নয়, উন্নয়ন মানে অন্য দেশকে ধনী করা নয়। উন্নয়ন মানে বেকারত্ব নয়। এই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা; যে দেশটি বিশ্বের এক নম্বর ধনী রাষ্ট্র, এক নম্বর অর্থনীতির রাষ্ট্র, মুরব্বি রাষ্ট্র। এই দেশ উন্নতি করেছে বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে, অবাধ পুঁজিবাদী বিকাশের পথ ধরে। সেখানে এখন পুরো আমেরিকার ধন-সম্পদের ৯৯ শতাংশের মালিক মাত্র এক শতাংশ মানুষ। অর্থনৈতিক বৈষম্য চূড়ান্ত। বিপরীতে বিগত ৬০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জিডিপি’ ৬ গুণ বৃদ্ধি পেলেও মার্কিনীদের প্রকৃত মজুরি এই সময়ে এক পয়সাও বাড়েনি। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই সিটগলিজ বলছেন, অনেক মার্কিনী ২৫ বছর আগে অর্থনৈতিকভাবে যে অবস্থায় ছিলেন এখন তাদের অবস্থা আরও খারাপ। একজন মোটামুটি শিক্ষিত যুবকের পক্ষে চাকরি পাওয়া কঠিন। এমতাস্থায় প্রশ্নÑ উগ্র বাজার অর্থনীতি অনুসরণে ‘উন্নতি’ করে যদি চাকরির সংস্থান না হয়, বড় চাকরি যদি বিদেশীদের হাতে চলে যায়, প্রকৃত মজুরি যদি না বাড়ে, ধন-সম্পদ যদি এক শতাংশ লোকের হাতে কুক্ষিগত হয় তাহলে ‘উন্নয়ন’ ‘উন্নয়ন’, ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি করে কী লাভ হবে? এই প্রশ্ন এক সময় কমিউনিস্টরা করত। এখন আমেরিকাতেই এই প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্ন মার্কিন রাজনৈতিক কর্মী ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যেই এখন উঠেছে। উঠছে সব দেশে। আমাদের পাশের দেশ ভারত। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। তাদের পথও এখন বাজার অর্থনীতি। সেখানে কর্মসংস্থানের অবস্থা কী? মনে রাখতে হবে তাদের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার সাত শতাংশের ওপরে। বাজার অর্থনীতির সমর্থকরা ভারতের উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সেখানে দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থানের অবস্থা নাজুক। গত মাসে লক্ষাধিক যুবক-যুবতী মুম্বাই নগরীতে বেকারত্বের বিরুদ্ধে অভিনব এক প্রতিবাদের আয়োজন করে। তারা টানা ৬ ঘণ্টা মোটরসাইকেল চালায় মুম্বাইয়ের রাস্তায়। তাদের দাবি নিশ্চিত কর্মসংস্থানÑ সরকারী ও বেসরকারী কোম্পানিতে। দেখা যাচ্ছে দ্রুত উন্নয়নশীল ভারতের অর্থনীতিতে ২০১৫ সালে ১ কোটি ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ছিল। সেখানে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৩৫ হাজার লোকের। প্রকৃত মজুরির গতিও নিম্নমুখী। অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকারের। এর বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় ড. অমর্ত্য সেনের ‘ভারত-উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ গ্রন্থে। এই প্রেক্ষাপটে দেখা যাক বাংলাদেশের অবস্থা কী? কয়েকদিন আগে জনকণ্ঠেরই এক লেখায় আমি উল্লেখ করেছি ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে বাড়ছে। পাঁচ শতাংশ থেকে সাড়ে পাঁচ শতাংশ, সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ, ছয় শতাংশ থেকে সাড়ে ছয় শতাংশ হয়ে সাত শতাংশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উন্নীত হয়েছে। এটা খুবই প্রশংসার। কিন্তু যখন এর সঙ্গে কর্মসংস্থানের বিষয়টি মিলিয়ে দেখি তখন হোঁচট খেতে হয়। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে গড়ে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। তখন কর্মসংস্থানের হার ছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। কিন্তু এই সময়ে কর্মসংস্থানের হার হচ্ছে মাত্র ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তাহলে কী দাঁড়াল? ‘জিডিপি’ বাড়ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে। এরই পাশে দেখা যাক বিদেশীদের চাকরির বিষয়টি। কয়েকদিন পরপরই খবরের কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, বাংলাদেশে কয়েক লাখ বিদেশী আছেন যারা বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানায় নিয়োজিত। কেউ বলেন দুই লাখ, কেউ বলেন চার লাখ। আবার এও বলা হচ্ছে বছরে দুই থেকে তিন বিলিয়ন ডলার এরা বিদেশে পাঠাচ্ছেন। সংখ্যা এবং উল্টো রেমিটেন্সের পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে এ কথা সত্যি যে, আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে বিপুলসংখ্যক বিদেশী কাজ করেন। সিমেন্ট, ওষুধ এবং আইটি থেকে শুরু করে বহু শিল্পে বিদেশীরা কাজ করেন, অথচ দেশীয় ছেলেমেয়েরা বেকার। শিল্পের মালিকরা বলেন, দেশীয়রা কোন কাজের নয়। মালিকরা নানা ছল-চাতুরি করে বিদেশীদের কারখানায় নিয়োজিত করেন, ‘প্রটেকশন’ দেন। দেখা যাচ্ছে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি ও উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চাকরিও চলে যাচ্ছে বিদেশীদের হাতে। বড় বড় ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট হাউসগুলো এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে। মার্কিন ‘বিগ হাউসগুলো’ যেমন বিদেশী কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে নানা কথা বলে, তেমনি বাংলাদেশী মালিকরাও একই কাজ করছে। তাহলে কী দাঁড়ালÑ ‘জিডিপি’ বাড়ল, আর আমরা ‘এ্যাকাউন্ট্যান্ট’ আনলাম বিদেশ থেকে, মার্কেটিং ম্যানেজার আনলাম বিদেশ থেকেÑ এর অর্থ কী? রফতানি করে দুই ডলার রোজগার করলাম, আধা ডলার বিদেশীদের পেছনে খরচ করলামÑ নিট ফল কী দাঁড়াল? প্রশ্ন আরও আছে। এই প্রশ্ন মজুরি নিয়ে। দৃশ্যত মজুরি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবার মুখেই একই কথা। মজুর পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তার দৈনিক মজুরি খাতার বাইরে। এ ধারণার ভিত্তি কী? সম্প্রতি কাগজে একটি নিবন্ধ পড়লাম। নিবন্ধটি রচনা করেছে ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার’ (আইএলও) একজন সাবেক উপদেষ্টা। এ দেশেরই লোক তিনি। ওই নিবন্ধে দেখলাম কৃষি খাতে নামিক মজুরি ২০১১-১২ অর্থবছরে বেড়েছে ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ওই বছরেই ভোক্তা মূল্যসূচক (সিসিআই) বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ভোক্তা মূল্যসূচক মানে মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির বিপরীতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর অর্থ গ্রামীণ মজুরের অবস্থার অবনতি ঘটল। তার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলো। ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও একই ঘটনা। গ্রামাঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধির পরিমাণ তখন ছিল ৫ দশমিক ১২ শতাংশ। অথচ সেই বছর ভোক্তা মূল্যসূচক বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ সেই বছরও গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। শহরের লোকের অবস্থাও তাই। দেখা যাচ্ছে আয় বাড়ছে ঠিকই; কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে আরও দ্রুত গতিতে। এটা অবস্থাপন্ন লোকদের বোঝানো যাবে না। একজন ড্রাইভার, দোকানের সেলসম্যান, পিয়ন-মেসেঞ্জার অথবা সিকিউরিটি স্টাফকে যে দামে আলু, বেগুন, মরিচ, পটোল, চিচিঙ্গা, ঝিঙা ইত্যাদি কিনতে হয় একজন মন্ত্রীকেও সেই দামেই কিনতে হয়। অনেক চাকরিজীবী নিজের ফ্ল্যাটে থাকেন। কিন্তু ওই শ্রেণীর কর্মচারীদের ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়। বেতন বৃদ্ধিতে ওপরের শ্রেণীর লোকের লাভ কিছুটা আছে, নিচের শ্রেণীর লোকদের তা নেই। অর্থাৎ দেখা যাবে আয় যেভাবে বৃদ্ধি পায় খরচ বৃদ্ধি পায় আরও বেশি হারে। এটা আজকের সমস্যা নয়। বহুদিনের সমস্যা। ‘উন্নয়নের’ সমস্যা। পাকিস্তান আমলে একজন সরাসরি ব্যাংক অফিসার ৫০০ টাকা বেতন পেত। এখন পায় ৪০ হাজার টাকা। আশি গুণ বেতন বৃদ্ধি। কিন্তু চাল বাদে বাকি জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এক শ’ থেকে তিন-চার শ’ গুণ। দুই টাকার পুঁটি মাছ কিনতে হয় ৪০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রকৃত আয় কমছে। মানুষ দরিদ্রতর হচ্ছে। ঠিক আমেরিকার সমস্যা, ভারতের সমস্যা, অন্যদের সমস্যা। বলাবাহুল্য, বৈষম্যের জন্মও এখানেই। অতএব, আমাদের শুধু ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি’, ‘বিনিয়োগ বিনিয়োগ’, ‘রফতানি রফতানি’ আওয়াজ তুললে হবে না, উন্নয়নের সঙ্গে যে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রতি এখন থেকে নজর দিতে হবে। অধিকতর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে, শুধু বিগ বিগ প্রজেক্ট নয়, যেখানে পর্যাপ্ত চাকরি নেই। আমাদের বিদেশী কর্মী নিয়োগ অন্ধভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে, দেশী ছেলেমেয়েদের চাকরি দিতে হবে, তাদের সেইমতো গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃত মজুরি বাড়াতে হবে, নামিক (নমিন্যাল) মজুরি নয়, যাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে আয় বৃদ্ধি বেশি হয়। আর বৈষম্য দূর করতে হবে। এক শতাংশের হাতে ৯৯ শতাংশ সম্পদ ছেড়ে দেয়া যাবে না। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×