ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

চতুর্থ অধ্যায় মহামান্য ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব উদ্্যাপন (গত বুধবারের পর) ১৯৬১ সাল বৈশ্বিক বিবেচনায় আর এক দিক দিয়েও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত বানদুং শীর্ষ সম্মেলনের কথা আমার স্মৃতিকথার প্রথম খ-ে বিবৃত হয়েছে। সেখানে যে একটি নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত উন্নয়নশীল দেশের নিজস্ব একটি আসর সৃষ্টির প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় তারই পরবর্তী বিকাশ হয় ’৬১ সালের বেলগ্রেড শীর্ষ সম্মেলনে। এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় ১ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর এবং মার্শাল যোসেফ টিটো তাতে মেজবানের ভূমিকা পালন করেন। যুগোস্লাভিয়ার টিটো, ভারতের প-িত নেহরু, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি শোকর্ণ, মিসরের রাষ্ট্রপতি নাসের এবং ঘানার রাষ্ট্রপতি এনক্রুমার নেতৃত্বে এই সম্মেলনেই জোটবহির্ভূত ন্যাম (ঘঅগ– ঘড়হ অষরমহবফ গবসনবৎং) জাতিগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৫৪ সালে মিসরে কর্ণেল নগিব সেখানকার নৃপতি রাজা ফয়সলকে বিতাড়ন করে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কর্নেল নগিবকে বিদায় করে কর্নেল নাসের হন মিসরের সর্বময় কর্তা। তিনি সিরিয়ার সঙ্গে মিসরকে যুক্ত করে গড়ে তুললেন সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র (টহরঃবফ অৎধন জবঢ়ঁনষরপ)। কিন্তু এই সংযুক্তি বাস্তবে কখনও রূপান্তরিত হলো না এবং মিসর ও সিরিয়া দু’দেশেই সামরিক কোন কর্তাব্যক্তি একনায়কত্ব চালিয়ে যেতে সক্ষম হন। গামাল আবদুল নাসের মিসরের একজন সফল সংস্কারক হিসেবে চৌদ্দ বছর (১৯৫৬ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। আরব দেশগুলোতে তিনি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণজাগরণে উৎসাহিত করেন এবং আরব আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিনিশ্চায়ক ভূমিকা পালন করেন। এই বছরই মহাকাশ অভিযানে আরও সাফল্য আসে। ১২ এপ্রিল সোভিয়েত রাশিয়ার ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশ ভ্রমণ করে আসলেন এবং ৫ মে-তে আমেরিকার এলান শেপার্ড সেই ভ্রমণটি সম্পন্ন করলেন। ইউরি গ্যাগারিনের রকেটের নাম ছিল ১ নম্বর ভস্টক-১। আর এলান শেপার্ডের রকেটের নাম ছিল মীর-৩। আমার মতে, আর একটি উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক ঘটনা ছিল ১৯ মে-তে ভারতের বরাক উপত্যকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। সে দেশের অসম প্রদেশে বাঙালীরা সেই সময় প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বাংলার দাবিতে করিমগঞ্জ, শিলচর এবং হাইলাকান্দিতে বিরাট বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং প্রায় ১৩ জন প্রাণ দিয়ে এই আন্দোলনটিকে সফল করেন। আমাদের দেশে এই বছরে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে ভিত্তি করে বুয়েট (ইধহমষধফবংয টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঊহমরহববৎরহম ্ ঞবপযহড়ষড়মু– ইটঊঞ) প্রতিষ্ঠা পায় এবং একই সঙ্গে ময়মনসিংয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এ বিষয়ে অবশ্যি একটি মজার ঘটনা বিবৃত করতে চাই। বুয়েট প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত সভা মুখ্যসচিব আজফরের দফতরে অনুষ্ঠিত হয়, আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে একটি অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, প্রকৌশলী এই কলেজের বর্তমান এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তত জমি ছিল না। তখন হিসাব করে দেখা গেল যে, কলেজের আইনগত দখল ৫০ একর জমিতে থাকা উচিত; যদিও সেখানে কিছু এলাকা অবৈধভাবে অন্যের দখলে ছিল। তখন প্রকৌশল কলেজের তদানীন্তন অধ্যক্ষ ড. আবদুর রশীদ বললেন যে, এই জমির সবটুকু যদি প্রকৌশল কলেজকে দেয়া যায় তাহলে বর্তমান অবস্থানেই বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ নিয়ে ১৩ বছরব্যাপী যে স্থবিরতা বিরাজ করছিল তারই প্রেক্ষিতে ড. রশীদ নতুন কোন জায়গার কথা কোনমতেই আমলে নিলেন না। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই কাহিনীটি পরবর্তী অধ্যায়ে বলার ইচ্ছা আছে)। পরবর্তী গুরুতর প্রশ্ন হলো যে, উপাচার্যের বেতন কত হবে? তখন বলা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯২১ সালে ভারতের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তখন উদ্দেশ্য ছিল এইটিই হবে ভারতে অনন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়। সে জন্য প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে উচ্চ বেতনে নিযুক্তি দেয়া হয়। সেই বেতনটি ছিল ৩ হাজার টাকা এবং তার সঙ্গে ছিল বিনা ভাড়ায় সুসজ্জিত একটি বাড়িতে থাকার অধিকার। আরও বলা হলো যে, পাকিস্তানে আমলাতন্ত্রে বেতন-ভাতার বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ না করলেও বিভাগীয় কমিশনারদের ২ হাজার টাকা বেতন-ভাতা দেয়ার কথা আছে। সম্ভবত মুখ্যসচিব পরামর্শ দিলেন যে, উপাচার্যের বেতন বিনা ভাড়ায় সুসজ্জিত বাড়িসহ ২৫০০ টাকা হওয়া উচিত। ড. রশীদ তখন জানালেন, তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে পান ১২০০ টাকা এবং সেটাই যথেষ্ট। খুব হলে সেটা ১৫০০ টাকা করা যায়। যা হোক, কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উপাচার্যের বেতন ২৫০০ টাকায়ই নির্ধারিত হলো এবং তাকে প্রাদেশিক সচিব মর্যাদা দেয়ার কথাও হলো। বাংলাদেশে এই বছরই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের জন্ম হয়। তবে নববর্ষ উৎসব পালন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। তবে যে অনুষ্ঠানটি বর্তমানে রমনার বটমূলে হয় সেটার সূচনা হয় ১৯৬৭ সালে। ছায়ানটের জন্ম এক হিসেবে বলা যায় একটি প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই হয়। পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানটিকে মোটেই সুনজরে দেখেনি এবং যাতে এই সময় কোন অনুষ্ঠান না হয় সেই ব্যবস্থাটি গ্রহণ করে। যেমন, সরকারি হুকুমে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে এই উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল তার অনুমতিপত্রটি বাতিল করা হয়। (আমি কিন্তু আগেই অনুমতিপত্র দিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমার এই অধিকারটি ছিল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নয় বরং আর্টস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।) সামরিক শাসনামলে একজন সরকারি কর্মকর্তার এই রকম বিভিন্ন পরিচয়ের কোনই মূল্য ছিল না। সুতরাং সরকারের ন্যাশনাল ব্যুরো অব রিকন্ট্রাকশনের হুকুমে আমাকে এই অনুমতিপত্রটি বাতিল করতে হয়। রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব পূর্ব পাকিস্তানে আসলে অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয় এবং অত্যধিক ধুমধামের কারণ ছিল একান্তই সরকারের বিরোধিতা। কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী ঢাকার খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেব রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের কঠোর বিরোধিতা করেন। তার ধারণা ছিল, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সমাজকে ইসলাম বিমুখ করছিল এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ছিলেন একান্ত উগ্রপন্থী। পূর্ব পাকিস্তানের লাট সাহেব মোনেম খান তো বিকল্প রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টির উদ্ভট ধারণা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। তবে বাঙালিদের সৌভাগ্য যে, সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে মুখ্যসচিব হয়ে আসেন একজন উর্দু কবি এবং সংস্কৃতিবান মানুষ সৈয়দ হাশেম রেজা। তিনি মূলত যুক্ত প্রদেশের (টহরঃবফ চৎড়ারহপব) অধিবাসী ছিলেন। তবে পাকিস্তানের করাচিতে ভারত বিভাগের পর তিনি তার বাসস্থান স্থাপন করেন। সে সময় একজন প্রাজ্ঞ প্রকৌশলী চুয়াডাঙ্গার আবদুল বারী মালিক চট্টগ্রাম নৌবন্দর সংস্থার চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তানের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্তি পান। তিনি তার যুগেই একজন সংস্কৃতিসেবী ছিলেন। তার বিয়ে তার অভিভাবকরা ঠিক করে দেন কিন্তু বিয়ের অব্যবহিত পরে তিনি তার স্ত্রী ফয়েজা বারী মালিককে শান্তি-নিকেতনে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। তার স্ত্রী এক সময় সরকারের একজন মন্ত্রী পর্যায়ের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। তার মেয়ে ফরিদা বারী মালিক শান্তি-নিকেতনে প্রশিক্ষিত একজন নামকরা রবীন্দ্র সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তার ছেলে ড. ফজলে বারী মালিক আমেরিকায় নামকরা অধ্যাপক ছিলেন এবং এরা ভাইবোন দু’জনই ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই হিসেবে বারী সাহেব আমার পিতৃতুল্য ছিলেন এবং আমি ছিলাম তার স্নেহের পাত্র। চলবে...
×