ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চক্ষু মেলিয়া ॥ নিয়ামত হোসেন

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

চক্ষু মেলিয়া ॥ নিয়ামত হোসেন

যা দেখছে তাই করছে ছোট্ট একটা খবর। খবরটি ছোট্ট একটি ছেলের। ছেলেটি ইংল্যান্ডের। স্কুলে পড়ে। ওইটুকু ছেলে, কিন্তু বুদ্ধিতে পাকা। একদিন করেছে কী, বাড়ি থেকে তার মায়ের হীরের আংটি চুরি করল। সেটি এনে তার ক্লাসের একটি ছোট্ট মেয়েকে পরিয়ে দিল উপহার হিসেবে। সঙ্গে প্রস্তাব ভালবাসার। মেয়েটি উপহার পেয়ে সেটি সটান হাজির করল তার বাপের কাছে। তিনি করলেন কী, সেটাকে কৌতুকভরে পোস্ট করলেন তার ফেসবুক এ্যাকাউন্টে। তারপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাড়া পড়ে গেল লাখো কোটি মানুষের মধ্যে। শুরু হলো হাসাহাসি নানা কৌতুক। ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে’ এটা না মানার কোন কারণ নেই। দেশে দেশে, কালে কালে কতজন যে এই ফাঁদে পা দিয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই। তা সম্ভবও নয়। কেউ পড়ে প্রকাশে, কেউ অপ্রকাশে। বকের মতো ফাঁদে পড়লে তখন তাকে কাঁদতে হয়। তবে বকের ওই ফাঁদ প্রেমের নয়, তাই গান আছে, ফান্দে পড়িয়া বগা... তবে নাক টিপলে দুধ বের হয় এমন কচি খোকাকে প্রেমে পড়তে দেখলে এবং তারই বয়সী একটি শিশুকে দামী অঙ্গুরীয় উপহার দিলে তাতে একটু অবাকই হতে হয়। হলো কি, একালে আরও কত কি শুনতে হবে নানা দেশে ভালবাসার বহুত রকম ধরন একালে দেখা যায়। সে সবই কচি শিশুদের নয়। ধেরে তরুণ-যুবাদের। সে সবের মধ্যে এমন কিছু থাকে যেগুলো কখনই কোন খবর হয় না। এমন কিছু কিছু থাকে যেগুলো রীতিমতো খবর হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে কোন কোন তরুণের ভালবাসার প্রস্তাবে তরুণীর ভয়ে হৃদকম্প শুরু হয়। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়, বেছে নিতে হয় বন্দীদশা ইত্যাদি। তখন বিষময় হয়ে ওঠে তার জীবন। কিন্তু উল্লিখিত ঘটনাটি বিলাতের। ওসব পাশ্চাত দেশীয় সমাজে শিশুরা ২৪ ঘণ্টা যা দেখছে তার দ্বারাই প্রভাবিত হবে তারা। চেষ্টা করবে হুবহু তাই শেখার। জগতজুড়ে সব দেশের শিশুরা বড়দের অনুকরণ করে থাকে। আর একালে টেলিভিশনসহ নানা প্রচার মাধ্যমে যা দেখে সেটাই নকল করার চেষ্টা করে। এই শিশুটি তাদের সমাজের বাস্তবতার শিকার। তবে এ ব্যাপারে কোন কিছু মন্তব্য না করে শুধু এটুকু বলা যায় এ কচি বাচ্চাটি নিশ্চিতভাবেই জানে না ভালবাসা কারে কয়। শাখামৃগ সমাচার একটি ছোট্ট শহর। লোকজন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। স্বাভাবিকভাবেই চলছে তাদের জীবনযাত্রা। কিন্তু তাদের সেই জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অন্য একটি প্রাণীর জীবন। প্রাণীটি হচ্ছে শাখামৃগ অর্থাৎ বাঁদর। রাস্তাঘাট, বাড়িতে, গাছে-দোকানপাট সবখানে সব সময় দেখা যাবে বাঁদর। আসছে, যাচ্ছে, চলছে-ফিরছে, হাঁটছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে ইচ্ছামতো। কোন ভয় নেই। বিরক্তি নেই, যেন স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করছে ওরা। থাইল্যান্ডের লোপ বুড়ি শহরের চেহারা এটাই। ছোট শহর। লোকজনও কম। কিন্তু শহরজুড়ে বাঁদর। ওখানকার লোকজন বাঁদরকে কিছু বলে না। আদর করে। বাঁদরকে আদর দিলে যে মাথায় ওঠে, ওখানেও ঠিক তাই হয়েছে। মাথায় অবশ্য ওঠেনি। উঠছে যেমন গাছে। তেমনি ঘরবাড়িতে, পথেঘাটে, বাজার, দোকানে। কী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান! বাজারে গিয়ে একটা কিছু তুলে নিচ্ছে, কেউ কিছু মনে করে না। দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ম্লানমুখে, দেখতে পেয়ে দোকানদার বাড়িয়ে দিল কোন খাদ্য। বেশ আছে বাঁদরগুলো। শহরের লোকেরা ওদের খুব ভালবাসে। রোজ এটা-ওটা কোন কিছু ওদের দেয়া তো হয়ই, প্রত্যেক বছর একটা নির্দিষ্ট দিনে ওদের জন্য আয়োজন করা হয় বিশেষ ভোজের। যেদিন এ উৎসবের আয়োজন করা হয়, সেদিন শহরের কয়েকটি স্থানে স্তূপাকারে রাখা হয় নানা খাবার। সারা শহরের বাঁদরসহ অন্যান্য এলাকা থেকেও এসে হাজির হয় বহু বাঁদর। তারপর ওদের কোলাহলমুখরিত খাদ্যোৎসব। এটা খাচ্ছে, ওটা একটু খেয়ে রেখে দিচ্ছে, একজন আরেকজনকে কোন খাদ্য নিতে সাহায্য করছে, কেউ আবার কোন খাবার নিয়ে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করছে। নানা দৃশ্য, নানা রকম মজা। সেদিন সারা শহরের লোকদের জন্য যেন আনন্দোৎসব। ১৯৮০ সাল থেকে চলছে বাঁদরদের এই উৎসব। এটা দেখার জন্য অনেক পর্যটকও হাজির হন সেখানে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সংবাদে এসব খবর জানা গেছে। মানুষ কোন প্রাণীকে ভালবাসলে তাকে আদর করলে সে প্রাণী যে মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকে তা সবার জানা। কোন প্রাণীকে আদর করলে তারা মানুষকে ভয় পায় না, মানুষের কাছে ঘুরে বেড়ায়। থাইল্যান্ডের ওই শহরটির বাঁদরদের অবস্থাও তাই। ওরা যেমন খাবার পাচ্ছে, স্নেহ পাচ্ছে, তেমনি আনন্দ পাচ্ছে মানুষও। পর্যটকদেরও ব্যাপারটা আকৃষ্ট করেছে। এ দেশেও এককালে বাঁদর-হনুমান ছিল অনেক। ছিল অনেক জাতের পাখি, পশু ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী। আবাস নষ্ট হওয়ার কারণে, খাবার না পেয়ে এবং মানুষের সর্বক্ষণিক দাবড়ানি খেয়ে অনেক ধরনের প্রাণী দেশছাড়া হয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। কেশবপুরের হনুমানের কথা সবার জানা। কোনমতে হয়ত টিকে আছে ওরা মানুষের যতœ পেয়ে, ওখানে ওরা আছে বহুদিন ধরে। ঢাকা শহরেও এক সময় ছিল অনেক বাঁদর। এক চাল থেকে আরেক চালে যেত। এখানে ওখানে ওদের দেখা যেত। কিন্তু সে ঢাকা আর নেই। এখন গাছপালা কোথায়? আর ষোলোতলা থেকে কুড়িতলা, বারোতলা থেকে আঠারো তলাÑ বাঁদরদের বাপেরও সাধ্য নেই লাফ দেয়ার। আর শুধু কি বিল্ডিং? পথে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গাড়ির হর্ন, ভটভটানি- বাঁদররা এখানে থাকবে কোথায়! পুরান ঢাকার কোন কোন এলাকায় এখনও মাঝেমধ্যে বাঁদরদের দেখা যায়। হয়ত কিছু দিন চলবে এভাবে, তারপর একদিন ওরাও ঢাকা ত্যাগ করবে। কোথাও আশ্রয় কিংবা কোন নিরালা বন-জঙ্গল না পেলে হয়ত দেশত্যাগ করবে নতুবা ত্যাগ করবে ধরাধাম! আমাদের এই শহরে আরও অনেক সবুজ এলাকা, সবুজ পার্ক, আরও গাছ, আরও ফল ও ফুলের গাছ লাগানো যে প্রয়োজন সে কথা উপলব্ধি করা হবে কবে? শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে অনেক গাছপালা লাগানো, অনেক পার্ক তৈরি করা, বন্য পশুপাখির জন্য অনেক নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলা এখন যে খুব জরুরী, সেটা উপলব্ধি করে এখনই কাজ শুরু না করলে একদিন দেশটি হয়ে উঠবে পশুপাখিশূন্য। সেটা কি ভাল হবে কারও জন্য!
×