ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি, রোনাল্ডো, নেইমারদের কান্না

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১ ডিসেম্বর ২০১৬

পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি, রোনাল্ডো, নেইমারদের কান্না

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ বিস্ময়কর উত্থানই বলতে হবে। ব্রাজিলের চাপেকোয়েন্স ফুটবল ক্লাব গত কয়েক বছর অসাধারণ সাফল্যে ভাস্বর হয়। চলমান মৌসুমও কাটছিল স্বপ্নের মতো। অনেকটা ইংলিশ ক্লাব লিচেস্টার সিটির মতো। যারা গত মৌসুমে রূপকথার জন্ম দিয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে শিরোপা জয় করেছিল। লিচেস্টারের মতো চাপেকোয়েন্স প্রথমবারের মতো চলে গিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকান ক্লাব ফুটবলের অন্যতম সেরা প্রতিযোগিতা, কোপা সুদ-আমেরিকার ফাইনালে। কিন্তু ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় হঠাৎ করেই থেমে গেল সেই স্বপ্নযাত্রা। টুর্নামেন্টটির ফাইনালে খেলার জন্যই কলম্বিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটির ফুটবলাররা। সবার চোখেই ছিল শিরোপা জয়ের স্বপ্ন। কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস। সব এখন এলোমেলো। মৃত্যুর কাছেই থেমে গেছে তাদের স্বপ্নযাত্রা। হৃদয় বিদারক, ভয়াবহ এ ঘটনায় গোটা বিশ্ব শোকে স্তব্ধ। সাবেক, বর্তমান ফুটবলারসহ সবাই এ ঘটনায় শোক জানিয়েছে। ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার বিশ্বাসই করতে পারছেন না। তিনি রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। নিজের দেশের ক্লাবের এমন পরিণতি বলেই নেইমারের কষ্ট যেন অন্যদের চেয়ে বেশি। চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি বার্সিলোনা তারকা। টুইটারে হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে কেঁদেছেন নেইমার। আহ্বান জানিয়েছেন সারা দুনিয়াকে কাঁদতে। শুধু নেইমার নয়, শোকবিহ্বল গোটা বিশ্বই। পেলে, দিয়াগো ম্যারাডোনা থেকে শুরু করে লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোসহ সবাই। পর্তুগাল অধিনায়ক নিজের সংহতি প্রকাশ করেছেন ফুটবলার ও কর্মকর্তাদের শোকার্ত পরিবারের প্রতি। ভালবাসা জানিয়েছেন ক্লাব ও ব্রাজিলীয় ফুটবলের প্রতি। মেসির? জন্য এই ঘটনাও অন্য এক অনুভূতির। এই একই বিমানে কিছুদিন আগেই উঠেছিলেন মেসি ও তার আর্জেন্টিনা সতীর্থরা। লামিয়া বিএই-১৪৬ এই ফ্লাইটেই মেসিরা ব্রাজিলে খেলতে গিয়েছিলেন। আরেক খবরে জানা গেছে, বুয়েন্স এইরেস থেকে সান জুয়ানেও মেসিরা এই বিমানে করে খেলতে গিয়েছিলেন কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে। সেবার বিমানযাত্রায় মেসি ও আর্জেন্টিনার বেশ ক’জন খেলোয়াড় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তীব্র ঝাঁকুনি ছিল বিমানে। সেই একই বিমানে এবার মৃত্যুর মিছিল হলো। মেসি সেই ক্রুদের ছবি দিয়েছেন ফেসবুকে। তাঁর মতো করেই জানিয়েছেন শোক। অল্প কথায়, কিন্তু হৃদয়ের সবটুকু ব্যথা নিয়ে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক বলেন, বিমান দুর্ঘটনায় নিহত চাপেকোয়েন্সের খেলোয়াড়, কর্মকর্তাদের শোকার্ত পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সকলের প্রতি আমার হৃদয়ের গভীর থেকে জানাই সহানুভূতি। সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার পেলের দৃষ্টিতে এটি বিশ্ব ফুটবলের বিরাট এক ট্র্যাজেডি। তিনি বলেন, শোকস্তব্ধ ব্রাজিলীয় ফুটবল। এটি ফুটবলের দুঃখজনক ঘটনা, অপূরণীয় ক্ষতি। নিহত ব্যক্তিরা যেন পরপারের জীবনে সুখে থাকেন, আনন্দে থাকেন। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক, সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ম্যারাডোনাও কাঁদছেন। তিনি বলেন, এরা বড় শক্তি হয়ে উঠছিল। নিহতদের জন্য খুব খারাপ লাগছে। ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্টিনো দুর্ঘটনার এই দিনটিকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম দুঃখজনক ও শোকাবহ দিন হিসেবে বলেছেন। এমন দুঃসহ অনুভূতির এই কঠিন সময়ে ফিফার পক্ষ থেকে তিনি ব্রাজিলের সব ফুটবলপ্রেমী ও ফুটবল সংশ্লিষ্টদের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সিলোনাও সমবেদনা জানিয়েছে শোকার্তদের প্রতি। লোমহর্ষক এ ঘটনায় থেমে গেছে চাপেকোয়েন্সের রূপকথার গল্প। ৪৩ বছর আগে, ১৯৭৩ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রাজিলের এই ক্লাবটির। ১৯৭৮ সালে তারা প্রথমবারের মতো খেলেছিল ব্রাজিলের প্রথম বিভাগ লীগে। কিন্তু ভাল নৈপুণ্য দেখাতে না পারায় আবার পড়তে হয়েছিল অবনমনের মুখে। দীর্ঘদিন নিচের সারির লীগগুলোতে খেলার পর আবার তাদের ভাগ্য খুলেছিল ২০১৪ সালে। সুযোগ পেয়েছিল ব্রাজিলের শীর্ষ লীগ, সিরিআতে খেলার। ২০১৫ সালে ১৪তম অবস্থানে থেকে লীগ শেষ করায় প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিয়েছিল কোপা সুদ-আমেরিকায়। এটি ইউরোপের অন্যতম সেরা প্রতিযোগিতা, ইউরোপা লীগের সমপর্যায়ের একটি টুর্নামেন্ট। রূপকথার উত্থান চূড়ান্ত লগ্নে যাওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল তাদের স্বপ্ন। ভুলে পাসপোর্ট নিয়ে না যাওয়ায় ক্লাবটির কোচের ছেলে কাইয়ো জুনিয়র ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন। পাসপোর্ট না থাকায় তাকে বিমানেই উঠতে দেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ২৫ বছর বয়সী কাইয়ো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইন্সটাগ্রাম ও ফেসবুকে লিখেছেন, বন্ধুরা আমি, আমার ভাই ও আমার মা বেঁচে আছি। এই মুহূর্তে আমাদের ধৈর্য ও ব্যক্তিগত কিছু সময় প্রয়োজন, বিশেষ করে আমার মায়ের। তবে সব বার্তার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। পাসপোর্ট ভুলে যাওয়ায় আমার যাওয়া হয়নি। বর্তমানে আমি সাও পাওলোতে আছি। কাইয়ো ছাড়াও ইনজুরির কারণে ক্লাবটির স্ট্রাইকার আলেজান্দ্রো মারটিনুচ্চিও বিমানে উঠতে পারেননি। তাই প্রাণে বেঁচেছেন তিনিও। বিমান বিধ্বস্তে চাপেকোয়েন্স ক্লাবটির অধিকাংশ খেলোয়াড় ও কর্মকর্তা মারা গেছেন। বেঁচে গেছেন ডিফেন্ডার, দুই গোলরক্ষক ও ফিজিও। এখন পর্যন্ত ছয়জনকে জীবিত উদ্ধার করার খবর পাওয়া গেছে। কলম্বিয়া কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা ষষ্ঠ একজনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। কলম্বিয়ার দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সংস্থা জানিয়েছে, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি খেলোয়াড় হেলিও হেরমিতো জামপিয়ের নেতোর উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাকে সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কোপা সুদ-আমেরিকার ফাইনালে চাপেকোয়েন্সের প্রতিপক্ষ ছিল কলম্বিয়ার ক্লাব এ্যাটলেটিকো ন্যাশিওনালও। তারাও এখন শোকাহত। শোকার্ত ক্লাবটি দারুণ একটা প্রস্তাব দিয়েছে। তারা বলেছে, শিরোপা যেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটিকে দিয়ে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা কনমেবলের কাছে প্রস্তাবও দিয়েছে তারা।
×