ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দাবি-চুক্তির ২৭টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনের ঘোষণা সন্তু লারমার

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১ ডিসেম্বর ২০১৬

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনের ঘোষণা সন্তু লারমার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তি চুক্তি) যথাযথ বাস্তবায়নে দশ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তিনি বলেন, দেশ-বিদেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে ‘অসত্য’ বক্তব্য প্রচার করে আসছে। বস্তুত মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের মধ্যে দায়সারা উদ্যোগ, চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে গড়িমসি এবং চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে অসত্য তথ্য প্রচার জুম্ম জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছে। এমন কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, সরকার জুম্ম জনগণসহ পার্বত্যবাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় চরমভাবে অনাগ্রহী। বিষয়টি রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের বিকল্প নাই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (শান্তি চুক্তি) ১৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বুধবার রাজধানীর সুন্দরবন হোটেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরার সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী রূপম প্রমুখ। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দীর্ঘ ১৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী হস্তান্তর; পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; অপারেশন উত্তরণসহ অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের স্ব-স্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন; পার্বত্য চট্টগ্রামের সব চাকুরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ, চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; সেটেলার বাঙালীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনও অবাস্তবায়িত রয়েছে। এমতাবস্থায় পার্বত্যবাসীরা, বিশেষত জুম্ম জনগণ নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত এক চরম বাস্তবতায় মুখোমুখি হয়ে কঠিন জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। সাংবাদিকদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের এক প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়নে প্রশাসন কর্তৃক আইনত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে দুইটি শাখা অফিস বানানো প্রয়োজন হলেও তা এখনও বানানো হয়নি। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা হয়নি, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রভৃতির অভাবে বিচারিক কাজগুলো করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। সন্তু লারমা আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এক শাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশন উত্তরণের নামে এক ধরনের সেনাশাসন রয়েছে। আর এই অপারেশন উত্তরণের নাম দিয়ে সেখানে তারা সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সদিচ্ছা, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অন্যতম অন্তরায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে রকম হওয়ার কথা ছিল সামগ্রিকভাবে সব কার্যক্রম পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের পক্ষে আছে বলা যায় না। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব, সেই ধরনের কোন বিষয় ছিল না। চুক্তি বাস্তবায়নে একদিকে প্রশাসন ও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর চরম অনীহা, অন্যদিকে দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ কর্তৃক যথাযথ পদক্ষেপ ও কর্মসূচী না নেয়ার কারণে চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চুক্তি হলো সেখানকার মানুষের অধিকারের সনদ। এই চুক্তি ১৯ বছরে বাস্তায়িত না হওয়া সত্যিই দুঃখজনক। আসলে চুক্তির ৪৮টি ধারা বনাম ২৫টি ধারা বাস্তবায়নের বিষয়টি অংকের বিষয় নয়। বিষয়টা হলো চুক্তির স্পিরিট কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। সবচেয়ে মূল বিষয় পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের ক্ষমতায়ন। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। নৈতিক দায়িত্বের আলোকে যেন সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করে সেজন্য নাগরিক সমাজ জনসংহতি সমিতির ১০ দফার সঙ্গে সংহতি জানাবে। ভূমি কমিশন আইন ও পার্বত্য চুক্তি নৈতিক দায়িত্ব থেকে যেন বাস্তবায়ন করে তা আমরা প্রত্যাশা করি। আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে বাংলাদেশ আমরা আশা করেছিলাম তা পার্বত্য চট্টগ্রামে আজও অলিখিত সামরিক শাসন বিরাজমান থাকার মধ্যে দিয়ে ভুলণ্ঠিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জনমত গঠন করতে হবে। নাগরিক সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলকে নিজস্ব কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সব জাতির সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
×