ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে দিবস উদ্বোধন ॥ রাজধানীতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা

আয়কর রিটার্ন দাখিলে উৎসবের আমেজ, ভিড়ে ঠাসা সব অফিস

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১ ডিসেম্বর ২০১৬

আয়কর রিটার্ন দাখিলে উৎসবের আমেজ, ভিড়ে ঠাসা সব অফিস

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আয়কর সপ্তাহের শেষ দিনে রাজধানীর প্রতিটি কর অফিসে ছিল রিটার্ন দাখিলে উৎসবের আমেজ। বুধবার রাজধানীর সব সার্কেল অফিসে ছিল করদাতাদের উপচেপড়া ভিড়। কোন কর অঞ্চলে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। দিনভর দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে রিটার্ন জমা দেন করদাতারা। এদিন শেষ মুহূর্তের তাড়ায় অফিসের সিঁড়িতে বসেই তথ্য পূরণ করতে দেখা যায় অনেক করদাতাকে। শেষ দিনে যারা কর অফিসগুলোতে ভিড় করেছেন তাদের অধিকাংশই জমা দিয়েছেন রিটার্ন। ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের কর প্রদানে উৎসাহিত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবারই প্রথম আয়কর সপ্তাহ পালন করেছে। বুধবার সকালে আয়কর দিবস উপলক্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রাঙ্গণে পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে র‌্যালির উদ্বোধন করেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দেবেন না, তারা সময়ের আবেদন করে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। করদাতাদের জন্য এনবিআরের দরজা সব সময় খোলা। তবে করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও যারা কর দেবেন না তাদের খুঁজে বের করা হবে বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। ‘সমৃদ্ধির সোনালি দিন, আনতে হলে আয়কর দিন’, ‘সুখী স্বদেশ গড়তে ভাই, আয়করের বিকল্প নাই’, ‘উদ্ভাবনে বাড়বে কর, দেশ হবে স্বনির্ভর’Ñ সেøাগানে ও ‘আমার জন্য আমার কর’ প্রতিপাদ্যে বুধবার পালিত হয়েছে জাতীয় আয়কর দিবস-২০১৬। দিবসটি উপলক্ষে সকাল সাতটায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রাঙ্গণে আয়কর দিবসের কর্মসূচীর উদ্বোধন ঘোষণা করেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমান। পরে বোর্ডের সামনে পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে র‌্যালির উদ্বোধন করেন তিনি। এরপর খোলা জীপে করে র‌্যালিতে অংশ নেন চেয়ারম্যান। র‌্যালিতে জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়, নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিকসহ সেলিব্রেটিরা অংশ নেন। র‌্যালিটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সামনে থেকে বের হয়ে মৎস্য ভবন, সুপ্রীমকোর্ট, জাতীয় প্রেসক্লাব হয়ে আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সামনে গিয়ে শেষ হয়। র‌্যালিতে আয়কর দিবসের সেøাগান সংবলিত ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার নিয়ে বোর্ড ও বিভিন্ন কর অঞ্চলের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। র‌্যালিকে দৃষ্টিনন্দন করতে অংশগ্রহণকারীরা আয়করের সেøাগান সংবলিত টি-শার্ট, ক্যাপ পরিধান করেন। এছাড়া র‌্যালিতে আয়কর সচেতনতা বাড়াতে গান, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, ঘোড়ারগাড়ি, আনসার-ভিডিপির বাদক দল অংশ নেয়। এ সময় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আজই (বুধবার) আয়কর বিবরণী দাখিলের শেষ সময়। এ সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে হবে। যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দেবেন না তারা সময়ের আবেদন করে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। করদাতাদের জন্য এনবিআরের দরজা সব সময় খোলা। তবে যারা করযোগ্য থাকা সত্ত্বেও আয়কর দিবেন না তাদের খুঁজে বের করা হবে। তিনি আরও বলেন, এবারে করবান্ধব পরিবেশে আয়কর রিটার্ন জমা নিতে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বুধবার রিটার্ন দাখিলের শেষ দিনে প্রতিটি কর অঞ্চলে যতক্ষণ করদাতা উপস্থিত থাকবেন ততক্ষণ তাদের রিটার্ন জমা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে সময় আর বাড়ানো হবে না। সকল করাঞ্চলে মেলার ন্যায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বজায় রাখার কথাও জানান নজিবুর রহমান। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে যে বার্তাটি পাচ্ছি সেটা হচ্ছে যদি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করি, নিয়মকানুন সহজ করি তাহলে করদাতারা করদানে কখনও পিছপা হবেন না। এজন্য আমি আমাদের কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানিয়েছি কেবলমাত্র একটা মাস নয়, সারাবছর যাতে সব অফিসে উপযুক্ত পরিবেশ থাকে। এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, অর্থমন্ত্রী বছরের শুরুতে ৩ লাখ নতুন করদাতা নিবন্ধন করার লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিলেন। তবে বছরের প্রথম চার মাসেই ৫ লাখ করদাতা নিবন্ধিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সর্বশেষ ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি এ বছর শেষে ২৫ লাখ নিবন্ধিত করদাতা দেখতে চান। ইতোমধ্যে আমরা সে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। আশাকরি আজকের (বুধবার) দিনের শেষে যে পরিসংখ্যান পাব তা ২৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। বুধবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি কর অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, অফিসের বাইরে প্যান্ডেল করে কর্মকর্তারা রিটার্ন জমা নিচ্ছেন। এতে অনেকটা মেলার মতো উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ভবনের ফটকগুলো রঙিন বেলুন দিয়ে সাজানো, রং-বেরঙের কাপড় দিয়ে মোড়ানো হয়েছে গেট। গ্যারেজের মধ্যে তৈরি করা ছোট ছোট বুথের সামনের চেয়ারে বসে আয়কর বিবরণীর ফরম পূরণ চলছে। ঢাকা কর অঞ্চলের বেশ কয়েকটি অফিস রয়েছে সেগুনবাগিচা এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনে দুটি আবাসিক ভবনের নিচতলায় কর অঞ্চল-১, কর অঞ্চল-৭ ও কর অঞ্চল-১১-এর তিনটি মেলা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগই নতুন করদাতা রিটার্ন পূরণ ও দাখিল করতে এসেছেন। অন্য করদাতাদের বেশ ভিড়ও রয়েছে। শেষ মুহূর্তের তাড়ায় অফিসের সিঁড়িতে বসেই তথ্য পূরণ করতে দেখা যায় কাউকে কাউকে। এর আগে করদাতাদের সুবিধার জন্য বুধবার সব ব্যাংকের শাখা রাত আটটা পর্যন্ত খোলা রাখারও নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বুধবার দুপুরে প্রথমবারের মতো আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে আবদুল হান্নান এসেছিলেন সেগুনবাগিচায় কর অঞ্চল-১০ এ। জানালেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, আমি নতুন করদাতা। দুই দিন আগে এসে রিটার্ন ফর্ম নিয়েছিলাম। জেনে গিয়েছিলাম কিভাবে রিটার্ন পূরণ করতে হয়, কি কি কাগজপত্র লাগবে। আজ (বুধবার) এসে জমা দিলাম। হান্নান বলেন, চিকিৎসক বন্ধুদের বেশিরভাগই আইনজীবীর মাধ্যমে জমা দিয়েছেন। আমি ভাবলাম, কর যেহেতু দেব, নিজে পূরণ করার অভিজ্ঞতা দরকার। বাড়তি টাকা কেন খরচ করব। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীও প্রথমবারের মতো কর দিচ্ছে। গত দু’দিন চেষ্টা করে আমার স্ত্রীও নিজেই পূরণ করেছে রিটার্ন ফর্ম। জমাও দিয়েছে। জানালেন, কষ্ট হলেও খুবই ভাল লাগছে কর দিতে পেরে। আয়কর সপ্তাহের শেষ দিনে আবদুল হান্নান ও তার স্ত্রীর মতো এমন বহু নতুন করদাতার আনাগোনা ছিল নগরীর সব কর অঞ্চলে। বুধবার বিকেলে কর অঞ্চল-১০ এর রিটার্ন দাখিল করতে এসেছিলেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাবিবুর রহমান। রিটার্ন পূরণ আর দাখিলে আইনজীবীর সহায়তা ছাড়া হয়রানির বর্ণনা শুনেছেন বাবার কাছে। হাবিবুর বলেন, বাবা বলেছেন, প্রথমবার আয়কর দিবি। যদি ভুল হয় সারাজীবন মাসুল দিতে হবে। ভাবলাম, নিজে কর দেব, অভিজ্ঞতা দরকার। তাই নিজেই এসে পূরণ করে জমা দিলাম। তিনি জানালেন, বাবার কথা ভুল প্রমাণিত হলো। কর্মকর্তারা খুবই সহযোগিতা করেছেন। শুধু আমি নই, সব নতুন করদাতাকে যেকোন বিষয়ে সহযোগিতা করছেন। নতুন করদাতারা এমনটাই চাই-বললেন তিনি। এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬-১৭ করবর্ষে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের আয়কর বিবরণী জমার সময় শেষ হয়েছে বুধবার। আজ বৃহস্পতিবার থেকে যারা রিটার্ন জমা দিতে চাইবেন যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে সময় বাড়িয়ে নিতে পারবেন করদাতারা। এজন্য ওই করদাতাকে নির্ধারিত করের ওপর প্রতি মাসে ২ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এর আগে রিটার্ন জমার সময় শেষের দিকে এসে গত ২১ নবেম্বর এক ঘোষণায় এনবিআর সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারসহ ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দেশের সব কর অঞ্চল কার্যালয় খোলা রাখার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা ১৮ লাখের মতো। এর মধ্যে গত বছর আয়কর বিবরণী জমা দেন ১৩ লাখ। জানা গেছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এর মধ্যে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। আয়কর থেকে আদায়ের লক্ষ্য ধরা আছে ৭১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। গত ১ থেকে ৭ নবেম্বর সারা সপ্তাহব্যাপী আয়কর মেলা থেকে ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকার কর আদায় হয়েছে বলে এনবিআর কর্মকর্তারা জানান। তারা আরও জানান, চলতি বছরে সরকারী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি যুবক শ্রেণীর করদাতা বেড়েছে। বিশেষ করে যেসব সরকারী কর্মকর্তার মূল বেতন ১৬ হাজার টাকার বেশি, তাদের প্রত্যেকের রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। এর ফলে এ অর্থবছরে চাকরিজীবীদের মধ্যে রিটার্ন জমার সংখ্যা ৪ লাখ বাড়বে। এছাড়া যাদের বছরে আয় আড়াই লাখ টাকার বেশি, তাদের সবাইকে রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এমনকি প্রত্যেক গাড়ির মালিক ও অভিজাত ক্লাবের সদস্যদের বছরে আড়াই লাখ টাকার কম আয় হলেও তাদের রিটার্ন জমা দিতে হবে। এছাড়া পেশাজীবী চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, জনপ্রতিনিধি ও আইনজীবীদের করযোগ্য আয় না থাকলেও রিটার্ন জমা নির্দেশনা দেয়া হয়।
×