ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশও বাস্তবায়ন হয়নি;###;তিন দফা অভিযানে বাধা ;###;উচ্ছেদ রোধে চলছে চাঁদাবাজি ;###;প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আধা ঘণ্টা পর ট্রেন চলবে ;###;যানজট ও মানুষের চাপ কমবে রাজধানীতে

সিন্ডিকেটের কবলে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রেল সম্প্রসারণ প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১ ডিসেম্বর ২০১৬

সিন্ডিকেটের কবলে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রেল সম্প্রসারণ প্রকল্প

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সিন্ডিকেটের কবলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডাবল রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প। দেড় বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রেল মন্ত্রণালয়ে একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়। এটি ছিল কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের জন্য রেললাইনের দু’পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা। এরপর তিন দফা অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ রেল মন্ত্রণালয়। কাজ শুরুর আগে রেললাইনের দু’পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বারবার বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে জড়িত জুরাইন এলাকার প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী। যার নেপথ্য নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় এক সংরক্ষিত নারী সাংসদ। সর্বশেষ মঙ্গলবার অভিযান পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে মামলা করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এতে দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদিকে বুধবার বিকেলে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতে মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের নামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে যোগাযোগ খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। আধাঘণ্টা পরপর ট্রেন চলবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন যাত্রীরা। এতে মেগাসিটি ঢাকার ওপর চাপ কমবে। নগরীতে যানজট কমার কথাও বলছেন তারা। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন রেলওয়ে কর্তাব্যক্তিরা। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় স্টেট অফিসার এস এম রেজাউল করীমের নেতৃত্বে রাজধানীর জুরাইনের রেলগেট সংলগ্ন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। এক ঘণ্টা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার পর রেলওয়ের জমিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠা ‘টিপটপ’ হোটেল ভাঙতে গেলে উচ্ছেদ কাজে বাধা দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সংরক্ষিত আসনের এমপি এ্যাডভোকেট সানজিদা খানম। তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় কিছু লোকজনও। উচ্ছেদকারী শ্রমিকরা টিপটপ হোটেল ভাঙতে গেলে সানজিদা খানম ওই হোটেলের মালিক কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে বোলডোজারের সামনে বসে পড়েন। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যসহ রেলওয়ের এস্টেট অফিসার তাকে সরে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। এ সময় সানজিদা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আমি সরকারের প্রতিনিধি। আমি বলছি, আপনারা পুলিশ নিয়ে চলে যান। আমি বেঁচে থাকতে এখানে কোন স্থাপনা ভাঙতে পারবেন না। এ কথা বলে তিনি হোটেলের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে পড়েন। এর মধ্যে রেলওয়ের জমিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠা বিভিন্ন দোকানদার সানজিদার পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভাঙ্গার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সাধারণ এলাকাবাসীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কয়েক শ’ নেতাকর্মী জড়ো হয়ে উচ্ছেদ অভিযানের পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। দুইপক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের একপর্যায়ে প্রায় শতাধিক পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা চালায়। এ ঘটনায় ওই রাতেই রেল কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করে। দেড় বছর আগের নির্দেশনা ॥ দুটি বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তুতি হিসেবে দেড় বছরের বেশি সময় আগে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইনের দু’পাশে সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে চিঠি পাঠানো হয় রেল মন্ত্রণালয়ে। এর পরপরই শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। পাশাপাশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নিয়মিত কার্যক্রমও চলমান ছিল। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেড় বছরেও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। প্রকল্পগুলোর মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডাবল রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের রেললাইনও যাওয়ার কথা আছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দেড় বছরের মধ্যে তিনবার অভিযান চালানো হয়েছে জুরাইন এলাকায়। কমলাপুর থেকে জুরাইন পর্যন্ত ইতোমধ্যে অবৈধ উচ্ছেদ শেষ হলেও ‘টিপটপ’ হোটেলকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় বারবার অভিযান বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, এই হোটেলের মালিক ৬ জন। পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বিএনপি নেতা সেলিম, শামীম দুই ভাই। তাদের সঙ্গে আছেন ভগ্নিপতি জামায়াত নেতা দেলোয়ার। তারাই স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বারবার উচ্ছেদ অভিযানে বাধা সৃষ্টি করছেন। স্থানীয় এক সাংসদের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, এখানে প্রায় পাঁচ শতাধিক দোকান রয়েছে। হোটেল মালিকদের দাপটের কারণে অন্য অবৈধ দোকানগুলোও উচ্ছেদ সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া হোটেলের কারণে রেললাইনের পাশ দিয়ে করা নতুন রাস্তাটি ব্যবহার করতে পারছে না স্থানীয় লোকজন। উচ্ছেদ অভিযানের সময়ে স্থানীয় এমপি সানজিদার সঙ্গে ব্যবসায়ীরাও প্রতিবাদে যোগ দেয়। তবে স্থানীয় লোকজন চান সকল বাধা উপেক্ষা করে প্রকল্পটি এগিয়ে যাক। কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ নাসিম মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, জুরাইন রেললাইন মোড় থেকে ঠাকুরবাগ পর্যন্ত তিন শতাধিক দোকান রয়েছে। এরা সিন্ডিকেট করে বারবার উচ্ছেদ অভিযানে বাধা সৃষ্টি করছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য সানজিদা খানম। তিনি বলেন, সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে আমরা সহযোগিতা করতে চাই। আমরা চাই নতুন রেললাইন প্রকল্পটি যেন কারও বাধার কারণে পিছিয়ে না যায়। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান ঠেকানোর নামে প্রতিটি দোকান থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন স্থানীয় এই আওয়ামী লীগ নেতা। ফের অভিযানের প্রস্তুতি ॥ রেলওয়ের বিভাগীয় এস্টেট অফিসার রেজাউল করিম বুধবার জনকণ্ঠকে জানান, এ পর্যন্ত তিনবার ওই এলাকার উচ্ছেদ অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবার উচ্ছেদে বাধা আসে। তিনি জানান, ফের উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। রেললাইনের দু’পাশে অবৈধ দখলদারদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি। প্রকল্প বাস্তবায়নে সুফল পাবেন দুই জেলার মানুষ ॥ রাজধানী ঢাকা থেকে সবচেয়ে কাছের জেলা নারায়ণগঞ্জ। নানা হিসাব বলছে, দিনে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের যাতায়াত দুই জেলার মধ্যে। সড়কপথে যানজট, পরিবহন সঙ্কটসহ নানা সমস্যা রয়েছে। এদিক বিবেচনায় নিয়ে দুই জেলার মধ্যে রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের এক জুলাই থেকে প্রকল্পের কাজ শুরুর কথা, যা শেষ হবে ২০১৭ সালের ৩০ জুন। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি বলতে তেমন কিছু নেই। মাত্র আর্থিক অগ্রগতি আছে ছয় ভাগ। তবুও মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পটি দ্রুত সময়ের মধ্যে গতি পাবে বলে আশাবাদ রেলওয়ে কর্তাব্যক্তিদের। রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, এখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে দিনে ১৪ জোড়া ট্রেন চলাচল করছে। কিন্তু আধাঘণ্টা পরপর ট্রেন পরিচালনার চাহিদা রয়েছে, যা এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এই রুটে যাত্রী অনেক বেশি। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জ থেকে নিয়মিত এসে ঢাকায় অফিস করা যাত্রীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতায়াতের সুবিধার জন্য ট্রেনকে বেছে নিয়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশন ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক আল ফাত্তাহ মোঃ মাসউদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এখন সিঙ্গেল লাইনের কারণে এই রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া যাতায়াতেও কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সিঙ্গেল লাইনে ট্রেন পরিচালনা করা হবে। তখন দ্রুত সময়ে যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ট্রেন পরিচালনা করা যাবে। যাত্রীদের চাহিদা আরও বেশি হলে বেশি পরিমাণ ট্রেন পরিচালনায় কোন সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ২০ মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন ছাড়বে। সময় বাঁচবে যাত্রীদের। এতে ঢাকামুখী মানুষের চাপ কমবে। অনেকেই নারায়ণগঞ্জ থেকে অফিস করতে উদ্বুদ্ধ হবেন। তেমনি নগরীতে যানজটের মাত্রাও আগের চেয়ে অনেকগুণ কমে আসবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। রেললাইনের দু’পাশে এখন নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান চলছে। যখন পুরোদমে কাজ শুরু হবে তখন যেসব পয়েন্টে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সমস্যা রয়েছে সেখানে আরও বেশি করে শক্তি প্রয়োগ করা হবে। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন সবই হবে। আশাকরি জনস্বার্থে কোন কাজ আটকে থাকবে না। তিনি বলেন, প্রকল্পের ফিজিক্যাল ডিজাইনের অগ্রগতি যথেষ্ঠ। এখন মূল টেন্ডার আহ্বান করব। ঠিকাদার নিয়োগ হয়ে গেলে পুরোদমে কাজ চলবে। তখন আশাকরি আর কোন বাধা থাকবে না। কদমতলী থানায় মামলা ॥ সরকারী কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে কদমতলী থানায় মামলা দায়ের করেছে। এতে আসামি করা হয়েছে টিপটপ হোটেলের ব্যবসায়ী সেলিম ও দেলোয়ার নামে দুইজনকে। থানা সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে ঢাকা অফিসের কাননগো গোলাম নবী বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রেক্ষিতে রাতেই অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বুধবার আসামিদের আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি ॥ জুরাইন এলাকার রেললাইনজুড়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বুধবার বিকেলে একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সেখানে গিয়ে ব্যবসায়ীদের বলেন, এলাকার বাজারসহ হোটেল উচ্ছেদ হবে না। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। ইতোমধ্যে সাংসদের সঙ্গে রেলমন্ত্রীসহ রেলওয়ের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের কথা হয়েছে। ওপর মহলে দ্রুত টাকা পাঠাতে হবে। এই বলে সকল দোকান থেকে টাকা তোলা হয়েছে। রাতে স্থানীয় একাধিক সূত্র জনকণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করে। তারা জানান, স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতা সোলেমান প্রতি দোকান থেকে ২০০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা পর্যন্ত তোলেন। এর আগে দোকানপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হয়েছে। এ সময় তার সঙ্গে আরও ৭-৮ জন ছিলেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সোলেমান সাংসদ সানজিদার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
×