ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অঞ্জন সরকার জিমি

বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১ ডিসেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা

১৯৯৭ সাল। বিশ্ব চলচ্চিত্রে ইরানী জাগরণ চলছে। আব্বাস কিয়েরোস্তামি, মহসেন মাখমালবাফ, জাফর পানাহি, মাজেদ মাজেদি, প্রমুখ খ্যাতিমান এশীয় পরিচালকের ভিড়ে ‘লাইফ ইন ফগ’ নামে, একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন এক কুর্দি তরুণ। নাম বাহমান গোবাদি। এটি ছিল তার নবম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তথ্যচিত্রটির ব্যাপক সাফল্যই তার শিল্পের ক্ষুধাকে উস্কে দেয়। পরবর্তীতে এই পরিচালকের ‘টার্টলস ক্যান ফ্লাই’, হাফ মুন, রাইনোসিজনসহ বেশ কয়েকটি ছবি বিশ্ব চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগিতাগুলোতে স্থান করে নেয় এবং পুরস্কৃত হয়। পৃথিবীর অনেক খ্যাতনামা পরিচালকই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাদের শিল্পজীবন শুরু করেছেন। এদের মধ্যে আব্বাস কিয়েরোস্তামি, এমির কুস্তরিকাসহ বিশ্ব চলচ্চিত্রের অনেক রথী-মহারথীই আছেন। ছোট ছোট চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে এরা নিজেদের মেধা, শিল্পবোধ, দর্শন, মনন ইত্যাদিকে যেমন ঝালিয়ে নিয়েছেন একদিকে, অন্যদিকে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কারিগরি দিকগুলোর ব্যবহার ও সম্ভাবনা রপ্ত করে নিয়েছেন; যা পরবর্তীতে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। এ সকল বিখ্যাত পরিচালকের প্রায় প্রত্যেকের আত্মজীবনীতে প্রথম জীবনে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তাদের চলচ্চিত্র কীভাবে তাদের চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছে তার বর্ণনা আছে। বাংলাদেশে অনেকেই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। গত এক দশকে অনেকগুলো শিল্পমানসম্পন্ন স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনী ও তথ্যচিত্র দেশের বাইরে সুনাম অর্জন করেছে। এগুলোর মধ্যে ইশতিয়াক জিকোর ৭২০ ডিগ্রী উল্লেখযোগ্য। তথ্যচিত্রের মধ্যে শাহীন দিল রিয়াজের লোহাখোর, কামার আহমেদ সাইমনের ‘শুনতে কি পাও’। এদের ধারাবাহিকতায় অনেক তরুণ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর অসংখ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশে। দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারদের নির্মিত স্বল্প ও মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এসব ছোট ছোট ছবির অনেকগুলোই আঙ্গিক ও বিষয়ে বিশ্বমানের। বিষয় ও কাহিনীর কাঠামো থেকে শুরু“করে দৃশ্য ধারণ, সম্পাদনা, শিল্প ও পোশাক নির্দেশনা, এমন কী ভিজ্যুয়াল গ্রাফিক্সেও নতুনত্ব নিয়ে আসছে বাংলাদেশের তরুণরা। তাদের এসব সৃষ্টিকর্মের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্যাটাগরির চলচ্চিত্র উৎসব হচ্ছে। যেসব স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব বাংলাদেশে আয়োজিত হয় তার মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক স্বল্প ও মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব’ সবচেয়ে প্রাচীন এবং কুলীনও বটে। প্রতি দু’বছর পর পর অনুষ্ঠিত হওয়া এই চলচ্চিত্র উৎসবটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্বমানের সব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। ঢাকা শহরের অনেক ভেন্যুতে খুবই কম দর্শনীর বিনিময়ে আগ্রহী দর্শকদের জন্য তারা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ করে দিয়েছে এই উৎসবের মাধ্যমে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এত সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও খুবই কম দর্শকই এসব বিশ্বমানের চলচ্চিত্র দেখতে আগ্রহী হয়। সাধারণ দর্শক তো দূরের কথা, যারা নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত তারাও বলতে গেলে এসব প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে না তেমন। এবার অনুষ্ঠিত হওয়া স্বল্প ও মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের ৭টি ভেন্যুর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত ভেন্যুগুলো ছাড়া অন্য ভেন্যুতে দর্শক সংখ্যা ছিল খুবই কম। এত সুন্দর ব্যবস্থাপনা, এত প্রচার; কোন কিছুই সাধারণ দর্শকদের আগ্রহী করে তুলতে পারছে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেসব নির্মাতার ছবি প্রদর্শিত হয় তারাও বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসে নিজের শর্টফিল্মটি দেখেই বেরিয়ে যান হল থেকে। পরবর্তী চলচ্চিত্রটি দেখার কোন আগ্রহই তাদের থাকে না। সবার ক্ষেত্রে সত্য না হলেও নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা। আমাদের চারপাশের রাষ্ট্রগুলো যখন সিনেমাকে তাদের মেধা ও মতামত প্রকাশের প্রধান হাতিয়ার বানিয়ে তুলছে তখন আমরা ক্রমশ চলচ্চিত্র বিমুখ হয়ে পড়ছি। হলে দর্শক নেই, প্রদর্শনীতে দর্শক নেই, কোথাও দর্শক নেই। সব দর্শক টিভি চ্যানেলে হিন্দী সিরিয়াল দেখছে। আমরা চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিকতার প্রসঙ্গ এলেই গ্রাম বাংলার দর্শকদের রুচির প্রতি নেতিবাচক ইঙ্গিত করতে কুণ্ঠাবোধ করি না, কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দর্শকরাও বিশ্বমানের ছবিগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখায় না। আমরা হলের নাজুক পরিবেশের অজুহাতে হলে গিয়ে সিনেমা দেখি না, কিন্তু এইসব রুচিসম্মত প্রদর্শনী কেন্দ্রগুলোতেও আসি না অনভ্যস্ততার কারণ দেখিয়ে। অনেকে বলেন, খবর পান না বলেই আসা হয় না, আবার অনেকে সময় মেলাতে পারেন না। এইসব ছেদোকথার আড়ালে শহুরে মধ্যবিত্ততার জীর্ণতাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করলেও লাভ হয় না তেমন। অথচ বাংলাদেশ সরকার চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে চলচ্চিত্রকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শিল্প’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ডিজিটাল ফরম্যাটের নতুন সব কারিগরি যন্ত্রপাতি এনে বিএফডিসিকে সমৃদ্ধ করেছে। নির্মাতাদের উৎসাহী করতে পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অনুদান দিচ্ছে। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে সরকারীভাবে। রাষ্ট্রের তরফ থেকে যা যা করার সম্ভব তাই করা হচ্ছে আমাদের রুগ্ন এ শিল্পকে গতিশীল করতে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না কোন। রাষ্ট্রের সব পৃষ্ঠপোষকতা ব্যর্থ হচ্ছে এই সেক্টরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি ও নির্বোধ চলচ্চিত্রজীবীদের সদিচ্ছার অভাবে। আশা করি সরকার একদিন সর্ষের ভেতরের সমস্ত ভূতগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে সমর্থ হবে। আমাদের মেধার কোন অভাব নেই। আমাদের ঘটনার কোন অভাব নেই। আমাদের সীমার কোন অভাব নেই। এমনকি আমাদের প্রতিবন্ধকতারও কোন অভাব নেই। বিশ্ব দরবারে আমাদের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থানই তার প্রমাণ। আমাদের চলচ্চিত্র এখন বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে নিয়মিত হয়ে উঠছে। প্রতিবছরই আমাদের দেশের কোন না কোন সিনেমা প্রেস্টিজিয়াস ফেস্টিভ্যালগুলোতে অংশগ্রহণ করে পুরস্কার নিয়ে আসছে। তরুণ পরিচালকরাই জিতে আনছে চলচ্চিত্রের সব দুর্লভ সম্মান। উদাহরণ হিসেবে ‘শুনতে কি পাও’ চলচ্চিত্রটির কথাই বলা যায়। কামাল আহমেদ সাইমন নির্মিত এই ডকু-ফিকশনটি একাই ‘সিনে দ্যু রিল’ সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এই প্রাপ্তির বিপরীতে কিছু অন্ধকার সত্যও রয়েছে। প্রায়ই বিভিন্ন পত্রিকায় খবর পাওয়া যায় আমাদের দেশের অনেক চলচ্চিত্র বিভিন্ন উৎসবে পুরস্কৃত হচ্ছে। এইসব সংবাদের বেশিরভাগই মিথ্যা ও বানোয়াট। যেসব চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার প্রাপ্তির কথা বলা হয় সেইসব উৎসবগুলোর বেশিরভাগই মনগড়া। অন্যগুলোর কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। কিছু খ্যাতিলোভী নির্মাতা নিজেদের নাম প্রচারের উদ্দেশ্যে নিজেরা এইসব কল্পকাহিনী বানিয়ে নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। এরা আসলে চলচ্চিত্রপ্রেমী না, এরা ফায়দাবাজ। শস্যক্ষেতে আগাছা থাকবেই। প্রকৃত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ভিড়ে সস্তা জনপ্রিয়তালোভী অসংখ্য নির্মাতাতে ছেয়ে গেছে চলচ্চিত্রের এই ক্ষেত্রটি। মাখন-বিলাসী এসব নির্মাতার টার্গেট টিভি নাটকেই সীমাবদ্ধ। দুয়েকজন টিভি নাটকের গ-ি পেরিয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র পর্যন্তও পৌঁছে যেতে পারে। তবে বিজ্ঞাপন নির্মাণের জন্য ভিন্ন এলেম দরকার যা সবাই রপ্ত করে উঠতে পারে না। এত অন্ধকারের ভিড়েও চলচ্চিত্র নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো এখনও অনেক কিছু আছে আমাদের। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে প্রদর্শিত হওয়া আমাদের চলচ্চিত্রগুলোই তার প্রমাণ। সীমাবদ্ধতাকে অস্ত্র বানিয়ে অবাক করার মতো অসংখ্য তথ্য ও কাহিনীচিত্র নির্মাণ করে মেধাবী তরুণরা তার স্বাক্ষর রাখছেন। প্রথাগত শিক্ষা, যথাযোগ্য প্রযুক্তি, সমকালীন রেফারেন্স, কারিগরি সহযোগিতা, কাক্সিক্ষত স্বীকৃতি; কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই শুধুমাত্র সাহস আর শুভবুদ্ধি দিয়েই জয় করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। সবেমাত্র আক্রমণ শুরু হয়েছে বলে তার কোন হাওয়া এসে আমাদের গায়ে লাগছে না বটে; কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় আগামী এক দশকের ভেতরে এদের কাঁধেই ভর করে বিশ্ব চলচ্চিত্রে নিজের দখল নেবে বাংলাদেশ। তখনও হয়ত আমাদের মধ্যবিত্ত শহুরে নাগরিকরা সময় এবং গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে হোঁচট খেয়ে পড়ে থাকবে সস্তা টিভি চ্যানেলগুলোর নোংরা কাদায়, তখন তাদের করুণা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। এই মুহূর্তে চলচ্চিত্র শিল্পের এসব মেধাবী তরুণের জন্য জরুরীভাবে সুষ্ঠু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কারিগরি সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রয়োজন, তাদের স্বীকৃতির যথাযোগ্য ব্যবস্থা করা। সঠিক ও নিরপেক্ষ জুরির মাধ্যমে বাছাই করে সেরা ছবিগুলোকে পৃথিবীর কুলীন চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করা দরকার। সেই সঙ্গে একটা তথ্যকেন্দ্র বানানো উচিত যেখান থেকে বিভিন্ন সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসগুলোতে ছবি জমা দেয়ার সঠিক তথ্য ও নিয়মাবলী পাওয়া যায়। যদি রাষ্ট্র এই ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ক্রিকেটের পরে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে স্থান পাইয়ে দিতে আমাদের চলচ্চিত্র ও স্থিরচিত্র শিল্প সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে।
×