ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

জঙ্গীবাদ ও প্রজন্মের ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ১ ডিসেম্বর ২০১৬

জঙ্গীবাদ ও প্রজন্মের ভবিষ্যত

সম্প্রতি জঙ্গীবাদের ঘটনাগুলো মানুষকে আতঙ্কিত করেনি বরং মানুষের মধ্যে এর বিরুদ্ধে এক ধরনের সচেতনতা ও প্রতিরোধের মনোভাব গড়ে তুলেছে। এটি আমাদের জন্য নিশ্চয়ই আনন্দের। বিশ্বের কিছু দেশ বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ নিয়ে তোলপাড় করলেও তারা তাদের দেশে জঙ্গীবাদকে নির্মূল করতে তো পারেইনি বরং এর উল্টো চিত্রটি চোখে পড়ছে। তাদের আক্রমণগুলো তারা আইএসের হামলা না বলে অন্যভাবে বলার চেষ্টা করছে কিন্তু আমাদের দেশে আইএসের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও তা প্রমাণ করার চেষ্টায় দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। একজন মানুষ কীভাবে জঙ্গীতে পরিণত হচ্ছে তার ভেতরের বিষয়টি নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবছি না। মানুষ থেকে জঙ্গীতে রূপান্তরের জন্য আমাদের ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো জটিল বিষয় বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন প্রকৃত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা। এখানে আমাদের ভাবনার জগতটাকে আমরা প্রসারিত করতে পারছি না। মানুষের ভাবনা যখন বাস্তবতাকে বিবেকের আয়নায় দেখতে পায়, তখন জঙ্গীবাদের শিকড় ওদের থাকে না। বিভিন্নভাবে আমরা জঙ্গী দমনের কথা বলে থাকি কিন্তু তরুণদের ভাবনার দিগন্ত উন্মোচনের কথা ভাবি না। যদি ভাবতে পারতাম তবে কখনও একজন তরুণ জঙ্গীবাদের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করত না। আমাদের দেশে জঙ্গীবাদের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যাদের পরিচয় পাচ্ছি তারা কানাডা, মালয়েশিয়া, আমেরিকা অথবা ইংল্যান্ড ফেরত অথবা সেই দেশগুলোতে বসে বাংলাদেশে কীভাবে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানো যায় তার নীলনক্সা আঁকছে। বিষয়টাকে এভাবে দেখা যেতে পারে, অভাবের কশাঘাতে জর্জরিত অতি দরিদ্র বাবা-মা তাদের জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে তার মেধাবী সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠায়। অনেক আশায় ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকে। আশা থাকে তাদের সন্তান আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উদার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আলোকিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। সুদূর প্রবাসে ধর্মান্ধ ও জঙ্গীগোষ্ঠী সেই মেধাবী ছাত্রটির একাকিত্বের সুযোগ গ্রহণ করছে। তারা প্রথমে তার সঙ্গে বিভিন্নভাবে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল অবলম্বন করছে। তার অভাব অনটনগুলো পূরণ করছে। এভাবে তরুণ মেধাবী ছাত্রটির মন জয়ের চেষ্টা করছে ও তাদের ভ্রান্তমতাদর্শে তাকে আকৃষ্ট করছে। যখন তারা এ বিষয়ে সফল হচ্ছে তখন মগজ ধোলাইয়ের কাজটি অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে সম্পূর্ণ করছে। এরপর সেই ছেলেটি যখন উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে আসছে তখন তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃত বিকাশ না ঘটে সংকীর্ণ ও উগ্র মনোবৃত্তির লক্ষণগুলো প্রকট হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে যদি সেই মেধাবী ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন তার দ্বারা অনেক ছাত্র প্রভাবিত হচ্ছে। ফলে বিদেশে জঙ্গীদের আবাদ করা সেই শিক্ষক শিক্ষা ও গবেষণার ধারণা থেকে নিজেকে বিচ্যুত করে কোমলমতি ছাত্রদের মধ্যে রক্ষণশীল ও একমুখী চিন্তাধারা তৈরি করছে। একসময় সে যেভাবে জঙ্গীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল একইভাবে সে তার ছাত্রদের জঙ্গীবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখানে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে না। কারণ জঙ্গী বানানোর জন্য বিদেশ থেকে বিভিন্নভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে চলে আসছে। এছাড়া দেশের মধ্যেও এই অপশক্তির শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে যারা দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে তাদের প্রকৃত সংখ্যা এবং বিদেশে তাদের চলাফেরা ও অন্যান্য কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে না। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইমো, স্ক্যাইপি ইত্যাদি মাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর প্রচেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ থেকে যারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে মাইগ্রেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব অর্জন করেছে তাদের মাধ্যমেও অপপ্রচারের ব্যাপারটি ঘটছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাকরি নিয়ে যারা অবস্থান করছে তাদের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের ধারণা, তারা যেহেতু বিদেশী নাগরিকত্ব অর্জন করেছে অথবা বিদেশে অবস্থান করছে কাজেই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এ পর্যায়ে সরকারের এর বিরুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপ ও কর্মকৌশল গ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের যে দূতাবাসগুলো রয়েছে তারা তাদের জনবল বাড়িয়ে সেখানে অবস্থানরত সকল বাংলাদেশীকে পর্যবেক্ষণের মধ্যে আনতে পারে। তবে জঙ্গীবাদ বিস্তারে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের সকল নাগরিককে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা উচিত হবে না। অনেক বাংলাদেশী বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এছাড়া আমাদের অর্থনীতিতে বিদেশ থেকে বাংলাদেশের নাগরিকদের পাঠানো রেমিটেন্সের অর্থ আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। শুধু দরকার বিদেশে অবস্থানরত সকল নাগরিকের প্রতি নজরদারি বাড়ানো ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ॥ দুই ॥ আরেকটি বিষয় আমাদের বর্তমানে ভাবিয়ে তুলছে সেটি হলো, আমাদের দেশের ভবিষ্যত নাগরিক হিসেবে যে শিশুরা রয়েছে তাদের মধ্যে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের বিকৃত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। একদিকে পরীক্ষা আর অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিশুরা যেন কোনভাবেই যেতে পারছে না। ফলে একজন শিশুর প্রকৃত মেধা ও মননশীলতা বিকাশের পরিবর্তে এক ধরনের রোবটতান্ত্রিক সমাজ তৈরি হচ্ছে। ফলে পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে শেখার বিশাল জগত রয়েছে তা শিক্ষার্থীদের কাছে অচেনাই রয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক হলেও শিশুদের মধ্যে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিকাশ ঘটছে না। ফলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকের মতো আরও অনেক প্রতিভাববান ব্যক্তিত্বের প্রভাব শিশুদের মধ্যে পড়ছে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, বাঙালী সংস্কৃতি ও বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন সহজভাবে শিশুদের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিশুদের জ্ঞান তার পাঠ্যসূচীর মধ্যেই সীমিত থাকছে। উন্নত চিন্তাধারা ও সৃজনশীল মনোভাব তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না। ফলে একটি রোবটকে যেভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ঠিক তেমনি পড়ালেখা ও পরীক্ষার চাপে পিষ্ট হয়ে শিশুটি তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। ফলে সে অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। কোনটি ভাল কোনটি মন্দ এই বিবেচনা শক্তি তার মধ্যে থাকে না। ফলে অতিরিক্ত লেখাপড়ার চাপে অতিষ্ঠ হয়ে শিশুটি একদিন বড় হয়ে মুক্তির পথ খোঁজে। আর জঙ্গীবাদের চরেরা সেই সুযোগে তার মধ্যে জঙ্গীবাদের বীজ বপন করে। বাড়তে থাকে জঙ্গীর সংখ্যা, বাড়তে থাকে ঘরছাড়া মানুষের সংখ্যা। বিষয়টি ভেবে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ॥ তিন ॥ প্রত্যেকটি ধর্মই মানুষকে সহনশীল ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। বাংলাদেশে আবহমানকাল ধরে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একত্রে মিলেমিশে বসবাস করে। তবে যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের ওপর আঘাত হানে তাদের ধর্ম ব্যবসায়ী ও জঙ্গী হিসেবে শনাক্ত করা যেতে পারে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যারা আক্রমণ করেছে প্রকৃত পক্ষে সন্ত্রাসই তাদের ধর্ম। আর প্রকৃত ধর্মপরায়ণ মানুষের কাছে সকল ধর্মের মানুষ সুরক্ষিত। বার্মার আরাকান রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর যারা আক্রমণ করছে তাদেরও আমরা জঙ্গী হিসেবে শনাক্ত করতে পারি। কোন ধর্মই অন্য ধর্মকে আঘাত করা অথবা অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করাকে সমর্থন করে না। এক্ষেত্রে আমরা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা উল্লেখ করতে পারি। একমাত্র অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন ও উদারতা তৈরি করা সম্ভব। আর সেই সম্ভাবনার দিকেই আমরা তাকিয়ে আছি। লেখক : বিভাগীয় প্রধান, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, ডুয়েট
×