ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফারুক খান

রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র এবং কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ১ ডিসেম্বর ২০১৬

রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র এবং কিছু কথা

বিদ্যুতের চাহিদা মিটাতেই রামপালে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সুন্দরবনের যাতে ক্ষতি না হয় সেদিক বিবেচনায় রেখেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিদ্যুতকেন্দ্রটি স্থাপন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি হবে আমদানি করা কয়লা দিয়ে। কয়লা আসবে সমুদ্রপথে। আবার প্রকল্পের জন্য পানিরও প্রয়োজন রয়েছে। সুন্দরবনের কথা বিবেচনা করে কতটুকু দূরে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করলে পরিবেশের কোন ক্ষতি হবে না সে বিষয়টিও ভাবা হয়েছে। এসব সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শেই করা হচ্ছে। দূষণ প্রতিরোধে সর্বাধুনিক যত ধরনের প্রযুক্তি পাওয়া যায়, সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। ফ্লু-গ্যাস টেম্পারেচার, নাইট্রোজেন, সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-ডাই অক্সাইড ইত্যাদির নিঃসরণ পর্যবেক্ষণের জন্য রিয়েল টাইম কন্টিনিউয়াস এমিশন মনিটরিং সিস্টেম (ঈঊগঝ) থাকবে। যাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যাবে। পাশাপাশি অন্যান্য দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রপাতি বসানো হবে। রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রে ইএসপি (ঊষবপঃৎড়-ংঃধঃরপ চৎবপরঢ়রঃধঃড়ৎ) থাকবে যা উদ্গিরণকৃত ফ্লাই এ্যাসের ৯৯.৯৯ শতাংশ ধরে রাখতে সক্ষম হবে। এই ছাই সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ব্যবহৃত হবে। একইভাবে এফজিডি (ঋষঁব মধং ফবংঁষঢ়যঁৎরুধঃরড়হ) স্থাপনের ফলে ৯৬ শতাংশ সালফার গ্যাস শোষিত হবে। এই সালফার গ্যাস থেকে জিপসাম সার তৈরি হবে। রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের চিমনির উচ্চতা হবে ২৭৫ মিটার। এই চিমনি দিয়ে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হবে তা বিদ্যুতকেন্দ্রের ১.৬ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্য যে সমস্ত গ্যাস সামান্য পরিমাণে বের হবে, সেগুলোর ঘনত্ব বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃত মাত্রার চেয়ে অনেক কম থাকবে। রামপালে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। একটি সাধারণ বিদ্যুতকেন্দ্রের কয়লা পোড়ানোর দক্ষতা যেখানে ২৮%, সেখানে আলট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্টের দক্ষতা ৪২-৪৩%। অর্থাৎ একই পরিমাণ কয়লা পুড়িয়ে আমরা দেড়গুণ বিদ্যুত পাব। সবচেয়ে গুণগত মানসম্পন্ন কয়লা এখানে ব্যবহার করা হবে। কয়লা আমদানি করা হবে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। যারা বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র পরিবেশ এবং প্রতিবেশের ক্ষতি করে, তারা একটু বড়পুকুরিয়া বিদ্যুতকেন্দ্র ঘুরে আসতে পারেন। বড়পুকুরিয়া একটি সাব-ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্ট। সাব-ক্রিটিক্যাল এবং আলট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল প্লান্টের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। সাব-ক্রিটিক্যালের তুলনায় সুপার ক্রিটিক্যালে ৪০ শতাংশ কার্বন, সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাস নিঃসরণ কম হয়। আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল প্লান্টে যে কোন দূষণের মাত্রা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব। প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এবং প্রকল্প থেকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের নিকটতম দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। কয়লার ধূলিকণা প্রতিরোধের জন্য ঢাকনাযুক্ত জাহাজে কয়লা আনা হবে। লাইটার্জে পরিবহনের সময়ও ঢাকনার ব্যবস্থা করা হবে। এতে বাতাসে কয়লার ধূলিকণা ছড়াতে পারবে না। বিদ্যুতকেন্দ্রটিতে ২৭৫ মিটারের চিমনি ব্যবহার করা হবে। ফলে ধোঁয়া সুন্দরবনের ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। একটি কথা মনে রাখা দরকার, আমাদের যেখানে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা দশমিক ২০ টন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ২০ টন। যুক্তরাষ্ট্রে শহর, বনাঞ্চল এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র রয়েছে। তাদের পরিবেশের সমস্যা না হলে আমাদের হবে কেন। সরকার সবার কাছে স্বল্পমূল্যে বিদ্যুত দিতে চায়। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অধিকাংশই তেলভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র। কাজেই সরকার এখানে একটি সাশ্রয়ী বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করছে। বিদ্যুতকেন্দ্রটিতে সুপার ক্রিটিক্যাল বয়লার টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। যা প্রচলিত তাপ বিদ্যুতকেন্দ্রের চেয়ে ১০ শতাংশ কম কার্বন নিঃসরণ করে। বিদ্যুতকেন্দ্রের চারপাশে বনায়নের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানো হবে। প্রকল্প থেকে নিয়ন্ত্রিত এবং পরিমিত গ্যাসীয় নিঃসরণ করবে। আশপাশে কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকায় নিঃসরিত গ্যাস কোথাও আটকে থাকবে না। এছাড়া প্রকল্পটি নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় অবস্থিত। নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড় সব সময় দূষিত বায়ুকে পরিশোধন করে। কোন রকম উত্তপ্ত পানি নদীতে ছাড়া হবে না। সব পানি ঠাণ্ডা করে নদীতে ছাড়া হবে। বায়ু দূষণ রোধে ছাই পৃথক করা হবে। প্রয়োজনে সালফার পৃথক করা হবে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া অথবা মোজাম্বিক থেকে কম সালফার যুক্ত কয়লা আমদানি করা হবে। শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য শব্দ প্রতিবন্ধক ব্যবহার করা হবে। তরল বর্জ্য পরিশোধন করা হবে। এছাড়া উৎপাদিত ছাই এর ৯৯ দশমিক ৯৮ ভাগ ধরে বিক্রি করা হবে। ২০২১ সালের মধ্যে সরকার সকলের কাছে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিশ্বে ৪১ ভাগ বিদ্যুত আসে কয়লা থেকে। আমরা সেখানে মাত্র এক ভাগ বিদ্যুত কয়লা থেকে উৎপাদন করব। আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত প্রয়োজন হবে। দেশে গ্যাসের স্বল্পতা থাকায় আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই। সুন্দরবনের যাতে ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর প্রায় দুই আড়াই বছর বিভিন্ন বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। কোনভাবেই যাতে বিদ্যুতকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক রাখা হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব শিল্পায়নের বিশ্ব। এখন সময় এগিয়ে যাওয়ার। আর এগিয়ে যেতে সবার আগে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে বিদ্যুত। কৃষি, শিল্পসহ সব ধরনের উন্নয়নেই বিদ্যুত অপরিহার্য। বিদ্যুতের উৎপাদনে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো বড় বড় দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করছে। তাদের উৎপাদনের একটি বড় অংশ আসে কয়লা থেকে। বাংলাদেশকেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। কারণ, অন্য জ্বালানির তুলনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কম। এই জন্য সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সরকার মাতারবাড়ি, পায়রা ও রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে। এসব বিদ্যুতকেন্দ্র আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে তৈরি। এতে পরিবেশের কোন ক্ষতি হবে না। বেকারত্ব দূর করার ক্ষেত্র বিদ্যুতকেন্দ্রটি হবে মাইলফলক সিদ্ধান্ত। কারণ, সুন্দরবনের পাশের জনসংখ্যার বেশিরভাগই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুতকেন্দ্র হলে মানুষের বিকল্প পেশার সুযোগ সৃষ্টি হবে। যাতে সুন্দরবনের ওপর চাপ কমবে। রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা করে যা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। বিশেষজ্ঞরাই বলছেন এ বিদ্যুতকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। বরং ওই এলাকায় নগরায়ণ হবে। নতুন নতুন শিল্প-কারখানা হবে। মানুষের কর্মসংস্থান হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবিকার জন্য দরিদ্র মানুষকে বনে যেতে হবে না। এ বিদ্যুতকেন্দ্র দক্ষিণাঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ। লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্য
×