ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

৩৬ বছরে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন

সংঘবদ্ধ নাট্য আন্দোলনের স্মৃতি- হাসি, রাশি আনন্দ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

সংঘবদ্ধ নাট্য আন্দোলনের স্মৃতি- হাসি, রাশি আনন্দ

মোরসালিন মিজান ॥ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অজস্র চাহিদা। হাজারো রকমের সঙ্কট। সীমাবদ্ধতা। এ অবস্থায়ও দারুণ এক আলো জ্বলে উঠেছিল ঢাকার মঞ্চে। শত প্রতিকূলতা দু’ হাতে ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন নাট্যকর্মীরা। জীবনের সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হন। সামাজিক জাগরণে ভূমিকা রাখেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে গঠিত হয় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। আরও উন্নত প্রযোজনা এবং আরও সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করে। মঙ্গলবার পথচলার ৩৫ বছর পূর্ণ করে ৩৬ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। দিবসটি উপলক্ষে মুখরিত ছিল নাটকের অঙ্গন। নানা আয়োজনে দিবসটি উদ্যাপন করা হয়। একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার সামনের সারির নাটকের দলগুলো একত্রিত হওয়ার লক্ষ্যে বৈঠকে বসে। বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা হয়। ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ফেডারেশনের প্রথম জাতীয় সম্মেলন। এতে ৬৭টি নাট্যগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে ফেডারেশনের পঞ্চদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ফেডারেশনভুক্ত নাট্যগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ১৭৫টি। বর্তমানে ফেডারেশনভুক্ত নাটকের দল প্রায় ৩০০। অর্জনও কম নয়। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন দিবসের উদ্যাপন তাই ঘটা করেই হয়। বিকেলে নাট্যকর্মীরা সমবেত হন আঁতুড় ঘর মহিলা সমিতিতে। সেখান থেকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শত শত নাট্যকর্মী এতে অংশ নেন। ব্যানার হাতে এগিয়ে চলেন শিল্পকলা একাডেমির দিকে। এ সময় নাট্যকর্মীদের হাতে ছিল বিভিন্ন সেøাগান লেখা প্ল্যাকার্ড। হলুদ টিশার্ট পরেছিলেন সবাই। তার পর নাচ গান আনন্দ। শোভাযাত্রা শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার নিচে পৌঁছলে যোগ দেন আরও অনেকে। বাদ্যযন্ত্র বেজে ওঠে। এভাবে বেশ কিছু সময় ধরে চলে উদ্যান। প্রায় একই সময় পরীক্ষণ থিয়েটার হলের লবিতে আয়োজন করা হয় নাট্যচিত্র প্রদর্শনীর। বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভ আয়োজিত প্রদর্শনীতে ১১৬টি আলোকচিত্র। সত্তর দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের নাটকের ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে। ১৯৭৩ সালে ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটির মাধ্যমে বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার সূচনা হয়। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের সেই নাটকের ছবি আজ গৌরবের ইতিহাস। আছে কালজয়ী নাট্য প্রয়াস ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’সহ বিখ্যাত সব নাটকের আলোকচিত্র। ‘নবান্ন’ নাটকের একটি আলোকচিত্র দেখে তো চোখ ছানাভরা! সাদাকালো ছবিতে অভিনয়রত শেখ কামাল! হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে। তার অভিনয় জীবনের কথা কজন জানেন? প্রদর্শনী খুঁটিয়ে দেখলে এমন আরও অনেক অজানাকে দেখার সুযোগ হয়। সন্ধ্যায় পরীক্ষণ থিয়েটার হলে তিন দশকের পথ চলার স্মৃতিচারণ করেন বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিরা। তাদের আলোচনায় পেছনের গল্পগুলো জানা যায়। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রথম সভাপতিম-লীর চেয়ারম্যান ছিলেন নাট্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। সংঘবদ্ধ পথচলার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা তার সঙ্গে। স্মৃতি হাতড়ে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের নাট্যদলগুলোর একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম চাই। থাকা দরকার। এমন চিন্তা থেকেই আমি সব দলের প্রতিনিধি নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলাম। ঢাকার সমমনা দলগুলো নিয়ে গঠিত হয় ফেডারেশন। আজ তিন দশকে এটি নাট্যকর্মীদের সমবেত শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এটা খুবই আনন্দের খবর। সে সময়ের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিশিষ্ট এই নাট্যজন বলেন, দল কম ছিল। মঞ্চ ছিল একটিÑ মহিলা সমিতি। পরে যোগ হয় গাইড হাউস। দুটি মঞ্চে ভাল নাটকগুলো বেশি বেশি করে মঞ্চস্থ হতো। প্রযোজনাগুলো আমলে নিয়েই বলা হতো, নাটকে নতুন জোয়ার এসেছে। এর পর কিছুটা অপূর্ণতার কথা। বিশিষ্ট এই নাট্যজন বলেন, নাটকের মান উন্নত করার একটি লক্ষ্য ছিল আমাদের। সেটি খুব যে হয়েছে তা বলা যাবে না। দলগুলোকে এদিকে আরও মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমি মনে করি, ভাল দলগুলোকে নাটক মঞ্চায়নের বেশি সুযোগ দেয়া উচিত। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে থেকেও যারা ভাল নাটক করে তাদের বিশেষ প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে। সব দলকে একভাবে দেখলে হবে না। যারা ভাল করে তাদের হল বরাদ্দ বেশি দিতে হবে। এতে নাটকের লাভ। ফেডারেশনের কাঠামোর মধ্যে থেকেই কিছু নিয়ম শিথিল করার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, দুই তিনটা দল মিলেও একটি প্রযোজনা মঞ্চে আনতে পারে। এতে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে। কাজও উন্নত হবে। কথা হয় ফেডারেশনের এই প্রজন্মের প্রতিনিধি ঝুনা চৌধুরীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ২৯টি দল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ফেডারেশন। আজ সংখ্যা ৩০০। এটা সত্যি আনন্দের। অর্জনও। যারা সূচনা করেছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা কক্ষচ্যুত হইনি। নাট্য আন্দোলন চর্চা চলছে। চলবে। হয়ত গ্রুপ থিয়েটার ফর্মুলায় টিকবে না। প্রফেশনাল থিয়েটারে যেতে হবে। তবে যে আকারেই হোক, দলব্ধভাবে কাজ করার উপর জোর দেন তিনি।
×