ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চামড়া শিল্প উন্নয়নে রোডম্যাপ হচ্ছে;###;সুনিয়ন্ত্রিত, সুপরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ

৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরাতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরাতে হবে

এম শাহজাহান ॥ রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চামড়া শিল্প উন্নয়নে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হচ্ছে। রোডম্যাপের আওতায় এ শিল্পের টেকসই উন্নয়নের রূপরেখা ঘোষণা করা হবে। একটি সুনিয়ন্ত্রিত, সুপরিকল্পিত এবং পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্প দেশে গড়ে উঠবে। আর এতে আগামী পাঁচ বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। রোডম্যাপ বাস্তবায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে ঢাকার অদূরে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য চূড়ান্ত নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সবুজ অর্থায়ন, মানসম্পন্ন কাঁচা চামড়ার যোগান নিশ্চিতকরণ, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট গঠন, দক্ষ জনবল প্রস্তুত এবং বিজ্ঞানসম্মত পশুপালন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। জানা গেছে, নতুন শিল্পনগরীতে ট্যানারি শিল্প পুরোদমে চালু করতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে অবকাঠামো খরচ বাবদ ব্যয় হবে ৩ হাজার কোটি এবং বাকি ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে শুধু মেশিনারিজ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে। সহজ শর্তে গ্রিন ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে এ তহবিল গঠন করা হবে। এ খাতের পরিবেশবিষয়ক সমস্যা সমাধানে সরকারী-বেসরকারী যৌথভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। চামড়া শিল্পের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন উদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে ৫০টি ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সাভারে ট্যানিং ড্রাম স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। ২৪টি ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান চামড়া শিল্পনগরীর কারখানায় উৎপাদন শুরু করেছে। কারখানা চালুর জন্য ২৫টি ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থায়ী বিদ্যুত সংযোগ নিয়েছে। এ পর্যন্ত পানির জন্য আবেদন করেছে ৪৩টি প্রতিষ্ঠান। আর গ্যাসের জন্য আবেদন করেছে ১০২টি ট্যানারি শিল্প। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই ১৫৫টি ট্যানারি শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীতে বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (বিপিসি) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) যৌথ উদ্যোগে ‘পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্প এবং টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক’ একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে চামড়া শিল্প উন্নয়নে ঘোষিত রোডম্যাপ দ্রুত প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া হয়। ইতোপূর্বে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ইপিবি’র যৌথ উদ্যোগেও রোডম্যাপ প্রণয়নে কয়েকটি বৈঠক করা হয়েছে। শীঘ্রই চামড়া শিল্প উন্নয়নে এই রোডম্যাপ ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, চামড়া শিল্প উন্নয়নে একটি পরিপূর্ণ রোডম্যাপ প্রণয়ন করছে সরকার। ইতোমধ্যে স্টেকহোল্ডারসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এ শিল্পের সম্ভাবনা, সমস্যা এবং যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এ শিল্পের টেকসই উন্নয়ন এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এলক্ষ্যে ইতোমধ্যে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে কারখানা সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, রোডম্যাপ প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে কয়েকটি মন্ত্রণালয় এবং উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে কাজ করছে। আশা করছি, শীঘ্রই রোডম্যাপটি ঘোষণা করা হবে। জানা গেছে, বিশ্বে ২১৫ বিলিয়ন ডলার চামড়ার বাজারে বাংলাদেশের অবদান ১ ভাগেরও কম। কিন্তু সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগানো গেলে রফতানি কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। আর এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্র্যান্ড ইমেজ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোঃ শাহিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, রোডম্যাপ প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের চামড়া শিল্প এগিয়ে যাবে। সহজলভ্য কাঁচামাল, চমৎকার গ্রেইন প্যাটার্ন, সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থার কারণে দেশের চামড়াশিল্প একটি সম্ভাবনাময় খাত। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকার পরও এ শিল্প গতি পাচ্ছে না। তিনি বলেন, মূলধনের অপ্রতুলতা, রিসার্স এবং ডেভেলপমেন্ট সেক্টরের অভাব, কঠিন বর্জ্য থেকে বিক্রয়যোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরির প্রযুক্তির অভাব, কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নের অভাব, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের স্বল্পতা এবং বাস্তবায়নযোগ্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। সাভার চামড়া শিল্পনগরীর নির্মাণাধীন সিইটিপি’র সিভিল কাজের ৮৮ ভাগ সম্পন্ন ॥ সরকারের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী নির্মাণাধীন সিইটিপির ২টি মডিউলের নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে দুটিতে ডেমো টেস্ট করা হয়েছে। বিসিকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি মডিউলে ৫০টি ট্যানারির বর্জ্যরে কাজ করা যাবে। এছাড়া চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের কাজ চলছে ঢিমেতালে। কিন্তু প্রতিদিন কাজ করা হলে দ্রুত এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে কর্মরত শ্রমিকরা জানিয়েছেন। হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প-কারখানা সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে পূর্ণাঙ্গভাবে স্থানান্তরিত না হওয়ায় এবং ট্যানারি বর্জ্য না পাওয়ায় আপাতত ধলেশ্বরী নদী দিয়ে ডেমো টেস্ট রান করা হচ্ছে। এছাড়া সিইটিপি নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইলেক্র-মেকানিক্যাল ইক্যুপমেন্ট আমদানির জন্য দ্বিতীয় এলসি খোলা হয়েছে। বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিআরটিসি ও বুয়েট সমন্বয়ে গঠিত প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশস কমিটি গত ২৬ থেকে ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত চীনে এলসি সংক্রান্ত মেশিনারিজ, ইক্যুপমেন্টস এবং ম্যাটেরিয়ালস পরিদর্শন করেছে। ইতোমধ্যে মালামাল এসে গেছে ও সংযোজনের কাজ চলছে। এছাড়া শীঘ্রই তৃতীয় এলসির মালামাল দেশে আনার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পে সরকারের ব্যয় ॥ ১ হাজার ৭৯ কোটি ব্যয়ে সাভারের হরিণধরায় চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হচ্ছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর হচ্ছে ১৫৫ ট্যানারি। এজন্য দেড় যুগেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। নগরীটির অবস্থান ঢাকার অদূরে সাভারের হরিণধরায়। নদী তীরে ২০০ একর জমির উপর গড়ে তোলা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব এ চামড়া শিল্পনগরী। গত ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। প্রায় ২০০ একর জমির ওপর করা ২০৫টি প্লটের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ১৫৫টি। এর মধ্যে লে-আউট প্ল্যান দাখিল করেছে ১৫৪টি, লে-আউট প্ল্যান অনুমোদন করেছে ১৫৪টি এবং মামলাজনিত কারণে ১টি ইউনিটের বরাদ্দ জারি করা যায়নি। ট্যানারিগুলোকে সেখানে স্থায়ী করতে এখন পুরোদমে চলছে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি ও তাগিদ রয়েছে সরকারের। আগামী বছরের জুন মাসে চামড়া শিল্পনগরী নামের এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে সিইটিপি (কমন ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) ও ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে সরকারের মোট ব্যয় হবে ৬৩৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ট্যানারি শিল্প স্থাপনে মালিকদের ক্ষুতিপূরণ বাবদ দেয়া হবে ২৫০ কোটি টাকা। পানি সরবরাহের জন্য প্রস্তুত ডব্লিউটিপি ॥ সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে পানি সরবরাহের জন্য শতভাগ প্রস্তুত ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ডব্লিউটিপি)। ইতোমধ্যে পানি সরবরাহের জন্য ১০টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় সাড়ে ৯ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করবে। এর মধ্যে এক লাখ লিটার পানি পান করার জন্য আর সাড়ে আট লাখ লিটার ট্যানারিগুলোতে সরবরাহ করা হবে। এই প্লান্টে কর্মরত আরডিএ (রুরাল ডেভেলপমেন্ট একাডেমি) সুপারভাইজার খন্দকার শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, পানি সরবরাহের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ডব্লিউটিপি। ট্যানারিগুলো চালু হওয়ায় পাম্পগুলো চালু করা যাচ্ছে না। পরীক্ষামূলকভাবে ডিপটিউবওয়েলগুলো প্রতিদিন একবার করে চালু করা হচ্ছে। আমাদের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ট্যানারি মালিকরা সংযোগ নিলেই পানি সবরবাহ করা হবে। এদিকে এ্যাপেক্স ট্যানারি, ঢাকা হাইড এ্যান্ড স্কিন লি., আরএমএম লেদার লি. ও রিলায়েন্স ট্যানারিসহ বড় বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দ্রুত তাদের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের এসব প্রতিষ্ঠান গত জুন মাস থেকেই এখানে ওয়েট ব্লু চামড়া উৎপাদনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এ কারণে এখন থেকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাঁচা চামড়া আনছে সাভারের শিল্পনগরীতে। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে রিলায়েন্স ট্যানারি। প্রতিষ্ঠানটি কাঁচা চামড়ার মজুদ করছে। এছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ওয়েট ব্লু চামড়া এনে মজুদ করছে। এ প্রসঙ্গে শিল্পসচিব মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, একেবারে সর্বশেষ টার্গেট দিয়ে দিয়েছি, আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে কারখানা স্থানান্তরিত করতে হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অনেকেই বিদ্যুত, গ্যাস সংযোগ নিয়েছেন, স্থাপনা তৈরি করছেন, অনেকেই শেষ পর্যায়ে আছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও ইটিপি করা হয়েছে, সেই মডিউলে অলরেডি কাজ শুরু হয়ে গেছে।
×