ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টি ইসলাম তারিক

স্বর্ণালী সময়ের সেরা তারকা আশীষ ভদ্র

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

স্বর্ণালী সময়ের সেরা তারকা আশীষ ভদ্র

যুদ্ধে জয় লাভের জন্য শুধু সৈন্যসামন্ত থাকলেই হয় না। প্রয়োজন একজন দক্ষ সেনাপতির। যিনি যুদ্ধের রণকৌশল সাজিয়ে থাকেন এবং যুদ্ধ পরিচালনা করে থাকেন। তেমনি ফুটবল ময়দানের যুদ্ধে জয়লাভের জন্য প্রয়োজন একজন দক্ষ ফুটবলারের। যিনি নিজে একাকি লড়বেন এবং পুরো দলকে নেতৃত্ব দেবেন। বাংলাদেশ ফুটবল মাঠে নেতৃত্ব দেয়ার মতো একজন ছিলেন যিনি যুদ্ধের ময়দানের প্রধান সেনাপতির মতোই। বাংলাদেশের লক্ষ্য ফুটবল সমর্থকরা আলাপ আলোচনায় আজও যার নাম নির্দিধায় স্মরণ করেন। তিনি মধ্যমাঠের সাবেক তারকা আশীষ ভদ্র। মধ্যমাঠের যে ক’জন ফুটবলার সমর্থকদের মনে আলাদা করে স্থান করে নিয়েছেন তাদের একজন আশীষ ভদ্র। দু’তিন জন ফুটবলারের মাঝখান দিয়ে বিপক্ষ সীমানায় চমৎকার বল ডেলিভারি ছিল তাক লাগানো। প্রতিপক্ষের কয়েক ফুটবলারকে বোকা বানিয়ে বল নিজের আয়ত্তে নিতে তার জুড়িমেলা ভার। লম্বা লম্বা পায়ে বল নিয়ে এগিয়ে যেতেন। দলের স্ট্রাইকিং জোনের প্লেয়ারদের কাজ ছিল শুধু গোলে বল পুশ করা! আশিষ ভদ্র ঢাকা ফুটবলে পা দিয়েই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। অত্যান্ত ঠা-া মাথায় বুদ্ধিদীপ্ত খেলা দিয়েই তিনি সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অষ্টম এসিয়ান গেমস ফুটবল দিয়েই তার জাতীয় দলের খেলার যাত্রা শুরু । আশীষ ভদ্র আবাহনীতে ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত খেলেছেন। মাঝখানে এক বছর মোহামেডানে। দীর্ঘ সময়ে আবাহনীতে খেলা দেশ সেরা মিডফিল্ডার আনুষ্ঠানিক বিদায় ছাড়াই ফুটবলকে গুডবাই বলেছেন। যা সমর্থকদের কাছে আজও রহস্য হয়ে আছে! কথা হয় চিটাগং এর শুভাশিস বড়ুয়ার সঙ্গে যার আশীষ ভদ্রের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক আছে। তিনি জানান, ‘আশীষ ভাই ছিলেন একজন জাত ট্যালেন্টেড খেলোয়াড়। তিনি ফুটবল ক্রিকেট টেনিস ক্যারম সব খেলাতেই পারদর্শী ছিলেন। আমি ছোটবেলায় তাকে ফলো করতাম। কিভাবে তার মতো একজন স্কিল খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে তৈরি করা যায়।’ আশীষ ভদ্র ২০১২ সালের জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। গৌরবময় এই পুরস্কারটি তিনি হাতে পেয়েছেন ২০১৬ সালে। খেলোয়াড় হিসেবে বহু দেশ সফর করেছেন। পজিশন মিডফিল্ড হলেও ক্লাব ফুটবলে এবং জাতীয় দলের হয়ে অনেক গোল আছে। মিডফিল্ড মাস্টার হিসেবে পরিচিত আশীষ খেলেছেন স্বল্প সময়। কিন্তু জায়গা করে আছেন ফুটবল সমর্থকদের হৃদয়জুড়ে। নম্র আর ঠা-া মেজাজের এই খেলোয়াড়টি কথা বলতে বলতে থমকে যান। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চোখ দুটো খুঁজে বেড়ায় হারানো সেই স্বর্ণালি অতীতকে। তার বিশ্বাস ষোলো কোটি মানুষের দেশে পরিকল্পনা মাফিক সঠিক মনিটরিং করলে ফুটবলার তৈরি কিংবা ফুটবলার খুঁজে বের করা কঠিন কোন কাজ নয় । ১৯৯০ সালের লীগ শেষ করে ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু আরেক নতুন জীবনে পা দিয়েছিলেন সে বছরেই। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সীমা চৌধুরীর সঙ্গে । তিনি পেশায় ডাক্তার। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার। ছেলে সিতাব ব্যাঙ্কক এআইটিতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করছেন। মেয়ে আহেলি পড়ছেন গ্রাফিক্স ডিজাইনে। এই কুশলী ফুটবলারের জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৬০ সালের ১৪ মার্চ। স্কুল ফুটবল থেকেই তার নাম ডাক। তবে ফুটবল ট্র্যাকে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন বর্তমান ক্রিকেটের ওপেনার তামিম ইকবালের বাবা প্রাক্তন ফুটবলার ইকবাল খান। এবার চলুন চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক আশীষ ভদ্র কি বললেন সেদিকেÑ * ফুটবলে কিভাবে নিজেকে জড়ালেন? ** স্কুল ফুটবল থেকেই যাত্রা শুরু। তবে বাসা থেকে কেউ চায়নি আমি ফুটবলার হই। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের কাজির দেউরি খাজা রিক্রিয়েশন ক্লাবের হয়ে চট্টগ্রাম প্রথম বিভাগ লীগ খেলি। ১৯৭৭ সালে আমি যখন কলেজের ছাত্র তখন আমি ওই ক্লাবের অধিনায়ক। আমার চলার পথ সহজ করে দিয়েছিলেন ক্রিকেটার তামিম ইকবালের আব্বা প্রাক্তন ফুটবলার ইকবাল খান। তার অনুপ্রেরণাতেই একজন ফুটবলার হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম। * ঢাকার ফুটবলে কিভাবে আসলেন? ** ১৯৭৭ সালেই জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় সিলেটের সঙ্গে জোনাল ম্যাচে চট্টগ্রামের হয়ে খেলি। আমার দেয়া দুই গোলে ৩-১ গোলে জয়লাভ করি। যে কারণে ঢাকা লীগে খেলার জন্য আর অপেক্ষা করতে হয়নি। আমি ১৯৭৮ সালেই যোগ দেই রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটিতে। প্রথম ম্যাচ ছিল ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে। ওই ম্যাচে খুব ভাল খেলেছিলাম। * আবাহনীতে কখন কিভাবে আসলেন? ** তিন বছর রহমতগঞ্জে খেলার পর আমার ডাক আসে আবাহনী থেকে। দলটির ডাকে সাড়া দিয়ে আমি ১৯৮১ সালে আকাশী হলুদ জার্সি গায়ে চাপাই। তারপর মাঝখানে এক বছর ছাড়া দীর্ঘদিন আবাহনীতে খেলেই আমার খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করি । * মাঝ খানের এক বছর ছন্দপতন কেন? ** (হাসতে হাসতে) সে সময় আবাহনীর ক্লাব সেক্রেটারির সঙ্গে হাল্কা মনোমালিন্য হয়েছিল। তাই অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আবাহনী ছেড়ে মোহামেডানে যোগ দেই। আবার পরের বছরেই আবাহনীতে ফিরে আসি। * বাংলাদেশ ফুটবলের এই হতশ্রী চেহারা কেন? ** অনেকেই এই বিষয়ে বলবেন ফুটবলারদের কমিটমেন্ট নেই। আমি এটা বিশ্বাস করি না। আসলে সঠিক স্থানে সঠিক লোকজন নেই। দুর্বল ম্যানেজমেন্ট। তাছাড়া ফুটবলের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা আছে তাদের অনুপস্থিতির কারণেই আজকে আমাদের ফুটবলের দৈন্যদশা। তিনি আরও বলেন ফুটবল এখন ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে ফুটবলকে বের করতে হবে। * বিপিএল তো ঢাকার বাইরেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাহলে ? ** হ্যাঁ, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু বিভিন্ন জেলার ক্লাবের নাম দিয়ে যে সমস্ত দল খেলছে তাদের স্থানীয় খেলোয়াড় ক’জন আছে সেটা ভেবে দেখা দরকার। খেলোয়াড় বের করে আনতে হবে গ্রামগঞ্জ থেকে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় লীগ জরুরী। একটা জিনিস খেয়াল করবেন আগে স্থানীয় লীগের পাশাপাশি কিন্তু শেরেবাংলা কাপ সোহরাওয়ার্দী কাপের মতো বড় বড় টুর্নামেন্টের আয়োজন হতো যেখান থেকে অনেক খেলোয়াড় উঠে এসেছে। এখন সেগুলো হচ্ছে না। সুতরাং নামকাওয়াস্তে এক বিপিএল দিয়ে আপনি কখনই খেলোয়াড় তৈরিসহ খেলার মান বাড়াতে পারবেন না। * বাফুফে অনুর্ধ ১২, ১৪ এবং ১৬ দল তৈরি করে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ জেলাভিত্তিক লীগ এবং শেরেবাংলা কাপ সোহরাওয়ার্দী কাপ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত। ** নিঃসন্দেহে ভাল উদ্যোগ। বাট ইট ইজ টু লেট। সালাহউদ্দিন ভাই ভাল খেলোয়াড় ছিলেন এবং অনেক মেধাসম্পন্ন মানুষ। আমরা আশা করেছিলাম উনি বাফুফেতে যোগদান করেই এই কাজগুলোর প্রতি নজর দেবেন এবং সবাইকে ইউনাইটেড করবেন। সেটা হয়নি। তার আসা আট বছর হয়ে গেছে। যদি তখন এই কাজগুলো শুরু করা যেত এতদিনে নিশ্চয় একটা রেজাল্ট আমরা পেতাম। আমাদের দেশে এই জাতীয় পদক্ষেপ এর কথা আগেও অনেক শুনেছি কিন্তু সেটা আলোচনা পর্যন্তই। বাস্তবে আর রূপ নেয়নি। * আপনি তো ১৯৯০ সালে লীগ খেলার পর ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন। তখন ফুটবলের সঙ্গে জড়িত হননি কেন? ** আমি চিটাগং আবাহনীর সঙ্গে জড়িত ছিলাম। বিভিন্ন কারণে পরে সেখান থেকে সরে আসি। * জাতীয় দলের হয়ে আপনার সেরা খেলা কোন্টি ? ** ১৯৭৮ সালে বিশতম এশিয় যুব ফুটবলে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে খেলাটি আমার কাছে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। ওই ম্যাচে আমরা ০-২ গোলে পিছিয়ে ছিলাম। হেলালের লব করা বল রাইট আউট পজিশন থেকে হেড দিয়ে একটি গোল পরিশোধ করি। পরে মহসিন আরও একটি গোল করলে খেলা ড্র হয়। * ক্লাবের হয়ে কোন্ খেলাটির কথা আজও মনে পড়ে ? ** ১৯৮৫ সালে লীগের ব্রদার্সের সঙ্গে খেলাটির কথা মনে হলে আজও শিহরিত হয়ে উঠি। ব্রাদার্স ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে সে ম্যাচটা হেরে যায়। মজার বিষয় হচ্ছে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার সময় ওয়াসিম আমার কাছ থেকে বল কেড়ে অমার্জনীয় মিস করে, যা অবিশ্বাস্য। ওই ম্যাচ আমরা ৩-২ গোলে জয় লাভ করি। * তখন বলা হতো আশীষ-বাবুল জুটি দেশ সেরা। শুনতে কেমন লাগত? ** ভাল লাগত শুনতে। তবে পুরা কৃতিত্ব আমি খুরশিদ বাবুলকে দেব। বাবুল ছিল অসাধারণ একজন খেলোয়াড়। যে শুধু দলকে দিতে জানে। মাঠজুড়ে সে খেলত। বাবুল মাঠে থাকলে আমি অনেকটাই রিল্যাক্স থাকতাম। যা করার সেই করত। অত্যন্ত পরিশ্রমী খেলোয়াড় ছিল। তার মতো খেলোয়াড় আজকাল চোখে পড়ে না। * ফুটবলে কোন কষ্ট আছে কি? ** নিজে একজন খেলোয়াড় হয়েও ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ফুটবলের সঙ্গে কোন সম্পৃক্ততা রাখতে পারছি না। কষ্ট এখানেই। এ কষ্ট শুধু আমার একার নয় এ কষ্ট অনেক সাবেক খেলোয়াড়দেরও। * তরুণ খেলোয়াড়দের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ। ** তরুণ খেলোয়াড়রা আজকাল মেসি আর নেইমারের চুলের কাটিং ফলো করে। এটা মোটেও ঠিক নয়। ফলো করতে হবে তাদের খেলার ধরন। নিজেকে স্কিলফুল খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করতে হবে। আর পড়াশোনা করতে হবে। কারণ পেটে বিদ্যা না থাকলে কোচিংয়ের লোড নেয়া যায় না। মনে রাখতে হবে ভাল খেলোয়াড় হতে পারলে টাকা তার পিছু নেবে। তাকে টাকার পেছনে দৌড়াতে হবে না। আমাদের সময় অনেক স্কিল খেলোয়াড় ছিল যাদের একক খেলা দেখার জন্য দর্শকরা মাঠে ভিড় জমিয়েছে। একবার আমরা জাতীয় দল নিয়ে পাকিস্তান গিয়েছি। আমাদের দলে গোলরক্ষক হিসেবে ছিলেন সান্টু ভাই। সম্ভবত একটি ম্যাচের আগে তিনি অসুস্থ ছিলেন। অনেক পাকিস্তানী সমর্থক সকাল থেকেই খোঁজখবর নেয়া শুরু করেন সান্টু ভাই খেলবে কি না। সান্টু ভাই তার নিজস্ব স্কিল দিয়ে সমর্থকদের মন জয় করেছিলেন। * বর্তমানে যদি বাফুফে আপনাকে ডাকে, আপনি কি ফুটবলের স্বার্থে সাড়া দেবেন ? ** অবশ্যই সাড়া দেব। অনেক সাবেক খেলোয়াড় আছে যারা ফুটবলের স্বার্থেই এগিয়ে আসতে চায়। কিন্তু বাফুফেকে তো সে পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি সেভাবে ডাকে এবং সাবেক খেলোয়াড়রা সাড়া দেয় অবশ্যই দেশের ফুটবলের জন্য সেটা হবে ইতিবাচক। এতে করে আমি মনে করি ক্লাবগুলো যেমন বেনিফিটেড হবে তেমনি দেশের ফুটবলও উপকৃত হবে।
×